আহমদ হাসান ইমরান: ২৫ বছরের তরুণ অ্যারন বুশনেল মার্কিন বিমান বাহিনীর একজন সিনিয়র এয়ারম্যান। এই তরুণ মার্কিন সেনাকে দেখা গেল তিনি সামরিক পোষাকে আমেরিকার রাজধানী ওয়াশিংটনে ইসরাইলি দূতাবাসের সামনে এসে উপস্থিত হয়েছেন। তারপর যা ঘটল, তা সমস্ত বিশ্ববাসীকে হতচকিত করেছে। এই তরুণ মার্কিন সেনা ইসরাইলি দূতাবাসের সামনে একাই দাঁড়িয়ে যায়নবাদী ইসরাইল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ফিলিস্তিনে যে জেনোসাইড (গণহত্যা) এবং জাতি সাফাই অভিযান ও ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে, তার বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠে সবর প্রতিবাদ জানান। এই তরুণ মার্কিন সেনা বলেন, আমি (তোমাদের দ্বারা সংঘটিত) গণহত্যায় কোনও মতেই আর সহযোগী থাকব না। আমি প্রতিবাদ স্বরূপ একটি চরম কাজ করতে চলেছি। কিন্তু যদি আমরা তুলনা করি, যারা ফিলিস্তিনের ভূমিতে দখলদারি ও উপনিবেশ স্থাপন করেছে, সেই ফিলিস্তিনের বাসিন্দারা যে চরম নৃশংস অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তা বিবেচনা করলে এটা মোটেই কোনও চরম কাজ নয়। এটাই আমাদের শাসক শ্রেণি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং তা মনে হবে যেন স্বাভাবিক। এরপরই প্রতিবাদ স্বরূপ ২৫ বছরের তরুণ অ্যারন বুশনেল একটি দাহ্য পদার্থ গায়ে ঢেলে আগুন লাগান এবং পুড়ে যাওয়ার সময় তিনি চিৎকার করে বলতে থাকেন ‘ফ্রি প্যালেস্টাইন- প্যালেস্টাইনকে আজাদ কর’। ইসরাইলি দূতাবাস থাকায় ওই এলাকাটি এমনিতেই ওয়াশিংটনের একটি স্পর্শকাতর অঞ্চল বলে পরিগণিত।
সংবাদমাধ্যম বলছে, অ্যারন বুশনেল গায়ে আগুন লাগালে সিক্রেট সার্ভিসের লোকেরা এসে আগুন নেভায়। এই মার্কিন বায়ুসেনাকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু সেখানেই এই তরুণ মৃত্যুবরণ করেছেন বলে জানানো হয়। জানা যাচ্ছে, ২০২০ সালে অ্যারন বুশনেল মার্কিন বিমান বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। অ্যারন বুশনেল তাঁর এই আগুন লাগানোর দৃশ্য লাইভ স্ট্রিম করে এবং ফেসবুকেও তা শেয়ার করেন। দেখা যায়, তিনি তাঁর প্রায় শেষ সময়েও ফ্রি প্যালেস্টাইন শ্লোগান দিয়ে চলেছেন। মার্কিন বিমান বাহিনীতে অ্যারন বুশনেলের সহকর্মী এবং বন্ধুরা বলছেন, অ্যারন বুশনেল ছিল বিমান বাহিনীতে খুবই দয়ালু, ভo এক তরুণ। তিনি ছিলেন খুবই শৃঙ্খলাপরায়ন। তিনি ছিলেন সদা হাস্যমুখ এবং বিভিন্ন মানুষকে সাহায্য করতেন। সেন্ট অ্যান্টোনিওতে গৃহহীন মানুষদেরও অ্যারন বুশনেল সাহায্য করেছিলেন। তিনি ছিলেন একজন প্রতিভাবান তরুণ। অ্যারন বুশনেল নিজের শ্লোগান ও শেষ মূহূর্তের ভিডিয়ো একটি সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্মে শেয়ার করেছিলেন। কিন্তু পরে কর্তৃপক্ষ তা প্রত্যাহার করে নেয়।
বর্তমানে ফিলিস্তিনের গাজায় নিহতের সংখ্যা প্রায় ৩০,০০০-এর কাছাকাছি পৌঁছেছে। আর আহতের সংখ্যা ৭৫,০০০-এরও বেশি। অবরুদ্ধ জনপদটিতে খাদ্য, পানীয় জল, চিকিৎসার ব্যবস্থা, ওষুধপত্র সব মানবিক সাহায্যের সরবরাহ ইসরাইল ও তার দোসর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন প্রভৃতি সভ্য রাষ্ট্র আটকে রেখেছে। গাজার প্রায় ২০ লক্ষ বাসিন্দা মৃত্যুর মুখে। তাদের মাথার উপর ছোট্ট একটি তাঁবুও নেই। আর ইসরাইলি সেনা ও বিমান বাহিনী তাদের তাড়িয়ে রাফায় জড়ো করেছে। আর সেখানেও চলছে হত্যালীলা। সভ্য দুনিয়া যারা মানবাধিকারের কথা বলে তারা টেলিভিশনের পর্দায় তাড়িয়ে তাড়িয়ে এইসব মর্মান্তিক দৃশ্য উপভোগ করছেন। একজন মার্কিন সেনেটার বলেছেন, ‘ফিলিস্তিনের সবাইকে হত্যা কর’। দেখা যাচ্ছে, আহত ও নিহতদের মধ্যে শিশু ও নারীদের সংখ্যাই প্রধান। কিন্তু তাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেনের মানবাধিকার ও সভ্যতার কোনও কিছু আসে যায় না। তারা ইসরাইলের নৃশংস গণহত্যার পক্ষে দাঁড়িয়েছেন এবং অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে ইসরাইলকে সর্বাত্মক মদদ করে চলেছেন। যুদ্ধবিরতি করে গণহত্যা বন্ধ করা হোক, রাষ্ট্রসংঘের এই প্রস্তাবে তিন তিনবার ভেটো দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অর্থাৎ কি না ইসরাইলি গণহত্যা অবাধে চলুক। যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানুষদের সম্পর্কে ধারণা হতে চলেছে যে, এরাও খুন, হত্যাযজ্ঞ জাতি সাফাইয়ের সমর্থক। সেই সময় অ্যারন বুশনেল তাঁর বিবেকের তাড়নায় প্রমাণ করেছেন, পৃথিবীতে এখনও মানবতা মরে যায়নি। ওই মার্কিন বায়ু সেনা নিজে আত্মাহুতি দিয়েও প্রমাণ করেছেন, এখনও মানবতা বেঁচে রয়েছে।
ইসরাইলি দূতাবাসের সামনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা পুষ্পস্তবক দিয়ে ও মোমবাতি জ্বালিয়ে অ্যারন বুশনেল-এর আত্মত্যাগকে সমর্থন জানাচ্ছেন। তাঁদেরও শ্লোগান হচ্ছে ‘ফ্রি প্যালেস্টাইন’ প্যালেস্টাইনকে আজাদ কর। সারা পৃথিবীর শান্তিকামী ও বিবেকবান মানুষ এই মার্কিন বায়ু সেনার জীবন দিয়ে প্রতিবাদ ও স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থানকে সালাম জানাচ্ছেন। অ্যারন বুশনেল মরে গিয়েও দুনিয়ার ইতিহাসে বেঁচে থাকবেন।