পুবের কলম, ওয়েবডেস্ক: হামাসের দেওয়া সমঝোতা প্রস্তাব মেনে নিতে বাধ্য হল ইসরাইল। বুধবার ইসরাইলি মন্ত্রিসভার বৈঠকে ভোটাভুটির মাধ্যমে ৪ দিনের সাময়িক যুদ্ধবিরতির চুক্তি মেনে নেয় নেতানিয়াহু সরকার। হামাস ইসরাইলের ৫০ জন জিম্মি এবং ইসরাইল ১৫০ জন ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দেবে বলে প্রাথমিকভাবে স্থির হয়েছে। হামাস জানিয়ে দিয়েছে, বৃহস্পতিবার গাজার স্থানীয় সময় সকাল দশটা থেকে যুদ্ধবিরতি চুক্তি কার্যকর হবে। ইতিমধ্যে কাতারের প্রধানমন্ত্রী আল থানির সঙ্গে বন্দিমুক্তি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার জন্য দোহায় উড়ে গেছেন ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের প্রধান ডেভিড বার্নিয়া। ৪ দিনের যুদ্ধবিরতি ও বন্দি বিনিময়ের চুক্তিকে হামাসের রাজনৈতিক, রণকৌশলগত ও মনস্তাত্ত্বিক জয় হিসেবে মনে করা হচ্ছে। এই চুক্তি নিয়ে আলোচনায় একদিকে ছিল হামাস, অন্যদিকে ইসরাইলি ক্যাবিনেট ও আমেরিকা। মাঝখানে মধ্যস্থতার ভূমিকা পালন করে গেছে কাতার। হামাসের শর্ত মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে শক্তিধর আমেরিকার যুদ্ধবাজ বন্ধু ইসরাইল। গাজাকে বিরানভূমিতে পরিণত করার যে হুমকি নেতানিয়াহু দিয়েছিলেন, তা থেকে সরে আসতে হল তাকে। হামাস গাজা ভূখণ্ডের একটি নির্বাচিত সরকার। একে কোনওভাবেই মানতে পারে না ইসরাইল, হামাস যোদ্ধাদের বলে ‘সন্ত্রাসী’। কিন্তু বাঙ্কারে থেকে দীর্ঘ ৪৭ দিনের যুদ্ধে তারা দেখিয়ে দিয়েছে, বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী। ফলে শেষমেশ হামাসের সঙ্গেই সমঝোতার হাত মেলাতে বাধ্য হল ইসরাইল। এই যুদ্ধবিরতি অস্থায়ী হলেও মধ্যস্থতাকারী কাতার জানিয়েছে, বন্দি বিনিময় চুক্তি ও যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলে পরবর্তী পর্যায়ে চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হতে পারে। ফলত আশার আলো দেখছে বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ। রাষ্ট্রসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন-সহ বিশ্বের বহু দেশ এই যুদ্ধবিরতিকে স্বাগত জানিয়েছে। তবে ইসরাইলের রাজধানী তেল আবিবে জড়ো হয়েছেন জিম্মিদের পরিবারের ক্ষুব্ধ লোকজন। তাদের অভিযোগ, মাত্র ৫০ জন জিম্মিকে ছাড়িয়ে আনতে পারছে নেতানিয়াহু সরকার। বাকিদের জীবনের কি কোনও দাম নেই? আমরা চাই সবাইকে ফিরিয়ে আনা হোক জীবিত অবস্থায়। উল্লেখ্য, হামাসের হাতে অন্ততপক্ষে ২৪০ জন ইসরাইলি বন্দি রয়েছে বলে দাবি করেছে নেতানিয়াহু সরকার।
দেড় মাসেরও বেশি সময় ধরে টানা যুদ্ধ চলছে ফিলিস্তিনে। ইসরাইলি বাহিনীর হাতে খুন হয়েছে ১৪ হাজারের বেশি মজলুম নাগরিক। আহত ৩৩ হাজারের বেশি। ভয়ংকর হত্যাযজ্ঞের প্রেক্ষাপটে গত সপ্তাহে কাতার ও মিশরের মধ্যস্থতায় ইসরাইলের কাছে যুদ্ধবিরতির একটি প্রস্তাব পাঠিয়েছিল কাতারে অবস্থানরত হামাসের হাইকমান্ড। সেটা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে নেতানিয়াহুর ক্যাবিনেট। যুদ্ধবিরতির যে শর্তগুলো উভয় পক্ষ মেনে নিয়েছে, সেগুলি দেখলেই বোঝা যাবে এটা আপাতভাবে হামাসের জয়। ৪ দিনের যুদ্ধবিরতিতে মুক্তি পাবে ৫০ ইসরাইলি ও ১৫০ ফিলিস্তিনি। নারী-শিশুদেরকেই মুক্তির ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেওয়া হবে। এই ক’দিন গাজায় নিজেদের মিলিটারি অপারেশন বন্ধ রাখতে হবে ইসরাইলকে। এমনকী সালাহ উদ দীন রোডে ইসরাইলি সেনা ও ট্যাঙ্কের টহলদারিও বন্ধ রাখতে হচ্ছে। বুধবার এক বিবৃতিতে হামাস জানিয়েছে, ইসরাইলি বাহিনী গাজার সব এলাকায় আকাশ ও স্থলপথে যেকোনও ধরনের অভিযান পরিচালনা থেকে বিরত থাকবে। চিকিৎসা সরঞ্জাম, জ্বালানি, ত্রাণ নিয়ে শত শত ট্রাক সীমান্ত পেরিয়ে অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় প্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছে। ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ এসব ট্রাককে গাজায় ঢোকার অনুমতি দেবে। হামাস আরও জানিয়েছে, দক্ষিণ গাজায় চার দিনের জন্য ড্রোন ওড়ানো বন্ধ রাখতে সম্মত হয়েছে ইসরাইল। আর উত্তর গাজায় প্রতিদিন ছয় ঘণ্টা (স্থানীয় সময় সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টে পর্যন্ত) ড্রোন ওড়ানো বন্ধ রাখা হবে। সাময়িক যুদ্ধবিরতি কার্যকর থাকা অবস্থায় গাজার যেকোনও এলাকা থেকে যে কাউকে আটক না করা কিংবা কারও উপর হামলা না করার বিষয়েও সম্মত হয়েছে ইসরাইল। বৃহস্পতিবার থেকে ১০-১২ জন করে ইসরাইলি বন্দিকে ছেড়ে দেবে হামাসের যোদ্ধারা। এ ছাড়া বন্দি মুক্তি নিয়ে আরও একটি প্রস্তাব দিয়েছে ইসরাইল। অতিরিক্ত ১০ জন বন্দিকে মুক্তি দিলে তার বিনিময়ে গাজায় আরও একদিন যুদ্ধবিরতি দেওয়া হবে। ৫০ জন বন্দির জন্য অনেকগুলি কড়া শর্ত মেনে নিতে হল নেতানিয়াহুকে। আসলে দেশের অভ্যন্তরে প্রবল বিক্ষোভ তৈরি হয়েছিল তার বিরুদ্ধে। বিশেষ করে বন্দিদের পরিবারগুলোর পক্ষ থেকে বার বার ব্যাপক প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। বিরোধী দলও চেপে ধরেছে নেতানিয়াহুকে। বিরোধীদের তিনজন এই চুক্তির বিপক্ষে ভোট দিয়েছে ক্যাবিনেটে।
এই চুক্তি মেনে নিলেও তেল আবিব হুমকি দিয়ে বলেছে, সব জিম্মিকে দেশে ফেরানো, হামাসকে পুরোপুরি নির্মূল করা এবং গাজা থেকে ইসরাইল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নতুন করে আর কোনও হুমকি নেই, এমনটা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চলবে। এটা যে তাদের আস্ফালন ছাড়া আর কিছুই নয়, তা অনুমান করা যায়। তবে মধ্যস্থতাকারী দেশ কাতারের আশা, সাময়িক এই চুক্তি দীর্ঘ মেয়াদে যুদ্ধ বন্ধের চুক্তিতে রূপ নেবে। কাতার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে এই চুক্তিতে। ফিলিস্তিনের গাজায় চলমান হামলা বন্ধে মধ্যস্থতা করে আসছিল কাতার। এ দিন সকালে ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে চার দিনের যুদ্ধবিরতির চুক্তির প্রথম ঘোষণাটি দেন কাতারের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র মাজেদ আল-আনসারি। তিনি বুধবার বলেন, কয়েক সপ্তাহ ধরে ব্যাপক আলোচনা ও দর-কষাকষির পর অবশেষে এই চুক্তিতে পৌঁছনো সম্ভব হয়েছে। এখন আমাদের নজর থাকবে বিবদমান দুই পক্ষের চুক্তির শর্ত মেনে চলার বিষয়টি নিশ্চিত করা। আল-আনাসরি আরও বলেন, দেখুন আমরা যা করতে পারলাম তা অন্য কেউ করতে পারেনি। এ কাজে আমরা পুরো দেশকে নিয়োজিত করেছি। এতে কাজ না হলে পরিস্থিতি আবার সংঘাতের দিকে যাবে।
বিশ্বনেতাদের প্রতিক্রিয়া ইসরাইল ও হামাসের যুদ্ধবিরতি চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছে আমেরিকা। এই চুক্তিতে মধ্যস্থতা করার জন্য কাতার ও মিশরের নেতাদের ধন্যবাদ দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। বাইডেন বলেছেন, এর মাধ্যমে জিম্মি দশায় থাকা ব্যক্তিরা তাদের পরিবারের সঙ্গে মিলিত হতে পারবেন। একইসঙ্গে যুদ্ধ কিছুদিন বন্ধ থাকায় গাজায় মানবিক ত্রাণ সহায়তা পাঠানো সম্ভব হবে। রাশিয়া জানিয়েছে, রাশিয়া-সহ বেশির-ভাগ দেশ যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে আসছিল। কারণ, যুদ্ধবিরতি হলেই কেবল সংঘাতের সমাধান নিয়ে আলোচনার অগ্রগতি হবে। চিনের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র মাও নিং বলেছেন, সামরিক যুদ্ধবিরতির এ চুক্তিকে আমরা স্বাগত জানাচ্ছি। এ চুক্তির মাধ্যমে মানবিক সংকট কিছুটা হলেও কমবে বলে আমরা আশা করছি।
ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতির চুক্তিকে সঠিক পথে যাওয়ার প্রথম ধাপ হিসেবে বর্ণনা করেছেন সউদি আরবের বিদেশমন্ত্রী যুবরাজ ফয়সাল বিন ফারহান আল-সউদ। মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি যুদ্ধবিরতির এ চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছেন। চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রো। ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েন বলেছেন, এ চুক্তির ফলে গাজায় আরও ত্রাণসহায়তা পাঠানো সম্ভব হবে বলে আশা করছি। তুরস্ক, ব্রিটেন, জার্মানিও চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছে।