সুবিদ আবদুল্লাহ্: তিন জুলাই মুর্শিদাবাদ-সহ এপার বাংলা ও বাংলাদেশে পালিত হল নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার শাহাদত দিবস। ১৭৫৭ সালের এই দিনে দেশ রক্ষার জন্য শহিদ হয়েছিলেন তিনি। বাংলা-বিহার-ওড়িশার নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার শহিদ হওয়ার দিনটি স্মরণে রেখে প্রতিবছর মুর্শিদাবাদ ও জেলার বাইরে থেকে মানুষ শ্রদ্ধা জানাতে আসেন খোশবাগে নবাবের পারিবারিক সমাধিক্ষেত্রে। এ দিন ছিল নবাবের ২৬৬তম শাহাদত দিবস। বর্ষা-বৃষ্টি উপেক্ষা করেও এ দিন মানুষ আসেন খোশবাগে।
এ দিন সকাল থেকেই আকাশের মুখ ছিল ভার। শহিদ তরুণ নবাবের শোকে ভরা বর্ষার কালোমেঘও যেন অশ্রুবিহ´ল। হঠাৎই বৃষ্টি নামল। পথে আটকা পড়লেন খোশবাগমুখী মানুষ। তবে ফিরে যাননি কোনও মানুষ। বৃষ্টি কমলে তাঁরা খোশবাগ আসেন। দুপুর গড়িয়ে গেলেও ছিল মানুষের আনাগেনা।
উল্লেখ্য, মুর্শিদাবাদের খোশবাগে নবাবদের পারিবারিক কবরস্থানে প্রিয় নানাজি নবাব আলিবর্দি খাঁ-র পাশে শায়িত রয়েছেন শহিদ নবাব। ১৭৪০ সালে নবাব আলিবর্দি খোশবাগ প্রতিষ্ঠার পর মাঝেমাঝেই পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এই বাগিচায় আসতেন। ১৭৫৬ সালে এখানেই তাঁর সমাধি রচিত হয়। কে জানত, পরের বছর তাঁরই পাশে আশ্রয় নেবেন আদরের নাতি সিরাজ।
ইতিহাসের পাতা থেকে জানা যায়, ১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা খোশবাগে শায়িত হলে তাঁর প্রিয়তমা পত্নী বেগম লুৎফুন্নিসা নবাবের হিরাঝিল প্রাসাদের জৌলুসময় জীবন ছেড়ে চলে আসেন খোশবাগে। আটপৌরে এক ঘরে বসবাস শুরু করেন শুধুমাত্র নবাবের কবর পরিচর্যা ও তাঁর জন্য দোয়া করার জন্য।
প্রতিদিন সকালে তিনি খোশবাগের ১০৮ রকম ফুলে শোভিত বাগান থেকে কোনও না কেনও তাজা ফুল এনে রাখতেন প্রিয়তম স্বামীর কবরের পাশে। সন্ধের নির্জনতাকে আলোকিত রাখতে নিজের কুঠিরে প্রদীপ জ্বালানোর আগেই তিনি প্রদীপ জ্বালাতেন সিরাজের কবরের পাশে।
নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা ও প্রিয়তমা পত্নী লুৎফুন্নিসার এই প্রেমকাহিনি ইতিহাসে বিরল। সিরাজের শাহাদতের ৩৩ বছর পর ১৭৯০ সালে নবাবের পাশেই আশ্রয় নিয়েছেন প্রিয়তমা পত্নী।
প্রতি বছর তিন জুলাই দিনটি মুর্শিদবাদ জুড়ে পালিত হয় ‘শহিদ দিবস’ হিসেবে। এ দিনও তার ব্যতিক্রম হয়নি। খুব সকালেই জেলা ও জেলার বাইরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অগণিত মানুষ এসে সমাধিক্ষেত্রের গেটে জমায়েত হন। বেলা বাড়তেই মানুষের ঢল নামে। তখনও গেট খোলা হয়নি। স্বাভাবিকভাবে এ দিন ভোরবেলা থেকেই গেট খুলে দেওয়া উচিত ছিল। গেট খোলা না পেয়ে রক্ষীদের সঙ্গে সিরাজপ্রেমী মানুষের বচসা শুরু হয়। শেষে রক্ষীরা গেট খুলে দিতে বাধ্য হন।
উপস্থিত মানুষদের কেউ কবর জিয়ারত করেন, কেউ বা নবাবের পায়ের কাছে ফুল রেখে শ্রদ্ধা প্রকাশ ও প্রার্থনা করেন। হাজির হয়েছিল অনেকগুলো সিরাজ-উদ-দৌলা প্রেমী সংগঠন।
এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য, কলকাতার বিশ্বকোষ পরিষদ, মুর্শিদাবাদের সিরাজ-উদ-দৌলা স্মরণ সমিতি, রেজিনগরের মীর-মদন-মোহনলাল স্মৃতিরক্ষা সমিতি, ভারত-পাকিস্তান পিপলস ফোরামের মুর্শিদাবাদ ইউনিট, আজাদহিন্দ স্বেচ্ছাসেবক সংঘ ও মুর্শিদাবাদের হিরাঝিল বাঁচাও সমিতি।
জিয়ারত ও প্রার্থনার পর কবরখানার গেটের সামনে মূল সভাটি হয়। নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার শাসনকাল ও পলাশি যুদ্ধের ওপর আলোকপাত করেন বর্ষীয়ান ইতিহাসবিদ আলিমুজ্জমান। বক্তব্য রাখেন জেলার বর্ষীয়ান সাহিত্যিক সামসুল আলম।
বিশ্বকোষ পরিষদের পক্ষ থেকে উপস্থিত সমাজকর্মী ডা. জাহাঙ্গির আলি এ দিন দাবি করেন, খোশবাগের পূর্ণাঙ্গ সংস্কার প্রয়োজন। সরকারের উচিত খোশবাগকে টুরিস্ট মানচিত্রের আওতায় নিয়ে আসা। দুই প্রাক্তন সেনানয়ক হাবিবুল্লাহ্ বিশ্বাস ও ধনঞ্জয় মণ্ডল নবাবের বিশ্বস্ত বীর সৈনিক মীর-মদন ও মোহনলালকে ভারতের ঐতিহাসিক সেনানায়ক হিসেবে শ্রদ্ধা জানানোর দাবি জানান।
খোশবাগ গেটের সামনে স্বাধীনতার শহিদ নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার মর্মরমূর্তি স্থাপনের কথা ছিল। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া থেকে কাজটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।
আর্কিওলজিক্যাল দফতরের মুর্শিদাবাদ ইউনিটের ডিরেক্টর হরিওম সাকেনকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, হেরিটেজ বিভাগের অনুমতি নেওয়া হয়নি। বন্ধ করা হয়েছে সে কারণেই।
এ ব্যাপারে মূর্তি স্থাপনের দায়িত্বে থাকা হিরাঝিল বাঁচাও কমিটির সম্পাদক সমর্পিতা দত্ত জানান, আমরা তো কবরখানার জয়গা দখল করে মূর্তি বসাতে চাইছি না। খোশবাগ এলাকাটি ডাহাপাড়া পঞ্চায়েতের অধীন। মূর্তি বসানোর জন্য জায়গা চেয়ে আমরা আবেদন করি ডাহাপাড়া পঞ্চায়েতে। এই আর্জি গ্রহণ করে নেয় পঞ্চায়েত। উদ্যোগ নেন পঞ্চায়েতের উপপ্রধান মাবের আলি। তাঁর চেষ্টায় জায়গাটি পাওয়া যায়। সেই জমিতেই মূর্তি প্রতিষ্ঠার কাজ চলছিল। হঠাৎ কাজটি বন্ধের নির্দেশ আসে।
ঠিক কী কারণে হেরিটেজ বিভাগ থেকে কাজ বন্ধ করল, তা জানতে চেয়ে শাহাদত দিবসের দিন লিখিত আবেদন করা হয় জেলা হেরিটেজ বিভাগে। সমর্পিতা দত্ত জানান, আবেদনের প্রতিলিপি দেওয়া হয়েছে জেলা পরিষদ এবং সেচ বিভাগেও। মূর্তি বসানোটা আসলে প্রতীকী। উদ্দেশ্য, বাংলা-বিহার-ওড়িশার শেষ স্বাধীন নবাবকে বাংলার মানুষ যেন ভুলে না যায়।