পুবের কলম,ওয়েব ডেস্ক: পশ্চিমবাংলার মুর্শিদাবাদ, মালদা, নদিয়া, দুই দিনাজপুর প্রভৃতি জেলা থেকে হাজার হাজার শ্রমিক রোজগার কিংবা একটু বেশি আয়ের খোঁজে কেরল, গুজরাত, মুম্বই, পুনে এমন কি সুদূর কাশ্মীরেও চলে যান, তা এখন সকলেরই জানা। এদের বেশিরভাগই হচ্ছেন মুসলিম ধর্মের। আগে মুম্বই, গুজরাতে এদের ‘বাংলাদেশী’ বলে চরম হরয়ানি করা হত। এখন তা একটু স্তিমিত হয়েছে। কিন্তু এখনও বাংলার এই দরিদ্র পরিযায়ী মুসলিম মজদুর ও কারিগরদের স্বভূমি পশ্চিমবাংলাতেই নানা ধরনের হেনস্থার শিকার হতে হচ্ছে।
এমনই একটি ঘটনা সামনে এসেছে শালিমার স্টেশনে। ১৪-১৫ জন মজদুর ও কারিগর কেরল থেকে বাড়ি ফিরছিলেন। বাড়ি ফেরার কারণ, গত দুই মাস ধরে কেরলে তাঁরা কাজ পাচ্ছিলেন না। তাঁদের অনেকেই বহু কষ্টে টাকা ধার করে ঘরে ফিরছিলেন। বেছে নিয়েছিলেন শালিমারগামী একটি ট্রেনকে। তাঁরা স্টেশনে নামতেই টিটিই-র পোশাক পরা পাঁচজনের একটি দল এই প্রবাসী শ্রমিকদের ঘিরে ধরেন। ওই টিকিট পরীক্ষকরা বুঝতে পারেন, এরা মুসলিম, খুব একটা শিক্ষা-দীক্ষা নেই এবং এদেরকে ভীতি প্রদর্শন করে ‘টাকা-পয়সা রোজগার’ করা যেতে পারে।
বৈধ টিকিট থাকা সত্ত্বেও ভয় দেখিয়ে জুলুম করে তাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করা হয় বলে এই সাংবাদিককে জানাচ্ছেন ওই পরিযায়ী শ্রমিকরা। ‘আমাদের টিকিট রয়েছে ফাইন দেব কেন? ওই পাঁচজন টিটিই টাকার দাবিতে অনড় থাকেন। মজদুররা বলেন, আমাদের কাছে তেমন টাকাকড়িও নেই।’ পরিযায়ী শ্রমিকদের এ কথা শুনে বেজায় চটে যান টিকিট পরীক্ষকরা। তাদের মারধর শুরু করেন টিকিট পরীক্ষকরা, অভিযোগ করছেন কেরল ফেরত শ্রমিকরা। এই ঘটনায় ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন তাঁরা। ঘটনাটি ঘটেছে শালিমার স্টেশনে। পরিযায়ী শ্রমিকদের হেনস্থা বন্ধ করতে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও সাংসদ অভিষেক বন্দোপাধ্যায় কাছে ইনসাফ চেয়েছেন এই মুসলিম পরিযায়ী শ্রমিকরা।
জানা গিয়েছে, কেরলের আলুভা স্টেশন থেকে শালিমার সুপার ফাস্ট এক্সপ্রেসে বাড়ি ফিরছিলেন এই পরিযায়ীরা। ১৪-১৫ জন শ্রমিক তাঁরা প্রত্যেকেই মুর্শিদাবাদের। বেশ কয়েকজনের রিজার্ভেশন টিকিট থাকলেও বাকিরা ৫১০ টাকা দিয়ে আলুভা স্টেশনেই সাধারণ টিকিট কেটে ট্রেনে চাপেন। যাদের রিজার্ভেশন টিকিট ছিল না, তাঁদের আলাদাভাবে ট্রেনেই ৫০০ টাকা ফাইন দিতে হয়। ট্রেনের কর্তব্যরত টিকিট পরীক্ষক তাদের ফাইনের রসিদ দিয়ে জানান, এই কাগজ নিয়েই তারা গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে। কোনও অসুবিধা হবে না। এরপর গত রবিবার বিকেলে কলকাতার শালিমার স্টেশনে নামতেই কয়েকজন টিটিই তাদের আটকায়।
শ্রমিকদের অভিযোগ, টিকিট দেখতে চাইলে তা দেখানো হয়। তারপরও তাদের নানাভাবে হেনস্থা ও গালাগালি করে টিটিরা। একজনের কাছে তথা কথিত ফাইন দেওয়ার টাকা না থাকায় তাকে ব্যাপক মারধর করা হয়। একজন হাতজোর করে বলে আমাদের কাছে ফাইন দেওয়রা টাকা নেই। কিন্তু সে-কথা শোনার বান্দা ছিলেন না ওই টিকিট পরীক্ষকরা। বাধ্য হয়ে একজন জলুমের হাত থেকে বাঁচতে অন্যের কাছে ধার করে টিকিট পরীক্ষককে টাকা দেয়। গলা চড়িয়ে টিকিট পরীক্ষক বলেন ‘উলঙ্গ করে ওর তল্লাশি নেওয়া হোক।’
মুর্শিদাবাদ জেলার ডোমকলের রঘুনাপুরের বাসিন্দা জিয়ারুল মণ্ডল (৩২) পরিবারের মুখে অন্ন তুলে দিতে দীর্ঘ ১২ বছর ধরে কেরলে শ্রমিকের কাজ করেন। ১৬ ও ১১ বছরের দুই ছেলের পড়াশোনার খরচ, সংসার খরচ ও ঋণের টাকা জোগাড় করতে হিমশিম অবস্থা তাঁর। গত ২ মাস কাজ না থাকায় বাড়ি ফেরার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। ৩ হাজার টাকা ধার করে বাড়ি ফিরছিলেন জিয়ারুল।
তাঁর অভিযোগ, ‘টিকিট পরীক্ষক তিনি কোথাকার নাগরিক তা জানার জন্য আধার কার্ড দেখানোর ফরমান জারি করে। সেটা দিতেই সঙ্গে সঙ্গে ধমক দিয়ে বলেন, এটা ‘জাল আধার কার্ড’ চালাকি হচ্ছে। এটা চলবে না, ভোটার কার্ড দেখাও। তারপর বলল টিকিট দেখাও। টিকিট দেখানো মাত্রহ এক টিকিট পরীক্ষক তা ছোঁ মেরে পকেটে ঢুকিয়ে নেন। তারপর ১৬৫০ টাকা ফাইন দাবি করেন। কিন্তু আমার কাছে ছিল ১২০০ টাকা। সবটা ভয় দেখিয়ে নিয়ে নেন তিনি। হাতে টাকা নেই। আমি ওঁর কাছে কাকুতি-মিনতি করি। পরে ৩০০ টাকা ফেরত দিয়েছিলেন। আমাকে ‘ফাইনের’ কোনও রসিদ দেওয়া হয়নি। পরে বুঝেছি দুর্বল বা শিক্ষাবিহীন কাউকে পেলে তাঁরা এভাবে টাকা রোজগারের ফন্দি করেন। আর জেলার মুসলিম হলে তো কথাই নেই। এরা সকলেই টিকিট পরীক্ষকের পোশাকেই ছিলেন। সেদিন আমার সঙ্গে আসা মুর্শিদাবাদের অন্য পরিযায়ী শ্রমিকরাও হেনস্থার শিকার হয়েছেন।’
ডোমকলের কামুড়দিয়ার সাহেবপাড়া বাসিন্দা রফিকুল ইসলামও বলেন, টিটিই-র অন্যায় জুলুমের শিকার তিনিও। রফিকুল ইসলাম জানান, ‘বৈধ টিকিট থাকার পরেও মোটা অঙ্কের ‘ফাইন’ করা হয়। তারপরও হেনস্থা করা হয়। আগে কিছু পুলিশ এমন অন্যায় জুলুম করত। এখন দেখছি টিটিরাই করছে। আমরা তো বেশ কয়েকটি রাজ্যে যাই, সেখানে কিন্তু এমন হেনস্থা করা হয় না। আর হচ্ছে আমার নিজের দেশ পশ্চিমবাংলায়।’