বিশেষ প্রতিবেদক: কেন গ্রেফতার করা হল চার সংখ্যালঘু যুবককে? কী ছিল তাদের অপরাধ? পুবের কলম-এ সম্পর্কে ১৮ আগস্ট একটি সবিস্তার প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। যে চারজন যুবক জিয়াউল লস্কর (৩৬), আবদুর রাজ্জাক (৩৪), সইদুল মুন্সি (৩৩) ও আকবর খানকে (৪০) হত্যা করা হল তাদেরকে যে কায়দায় পুলিশ তুলে নিয়ে যায়, তা মোটেই আইন-মাফিক নয়। এদের মধ্যে একজনকে তো তার বাড়ির পিছনের দিকের দরজা দিয়ে ঢুকে পুলিশ তুলে নিয়ে যায়।
কিন্তু আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মীরা প্রশ্ন তুলেছেন, এদের গ্রেফতার বা আটক করার জন্য পুলিশের কাছে কি কোনও ওয়ারেন্ট ছিল? ওয়ারেন্ট ছাড়া বাড়িতে প্রবেশ করে এই ধরনের গ্রেফতারি তো সম্পূর্ণ বেআইনি। একটি স্বাধীন দেশে কোনও নাগরিকের সঙ্গে পুলিশ এ ধরনের আচরণ করতে পারে না।
কিন্তু বারুইপুর বা মহেশতলা থানার আধিকারিকদের কে এ কথা বোঝাবে? তাদের কথা ও আচরণই এখানে আইন, বিশেষ করে সংখ্যালঘু গ্রাম ও মহল্লায়। নিহতদের তিনজনকে পুলিশ বাড়ি থেকে পরিবারের সামনে ধরে নিয়ে যায়। স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যদের প্রশ্ন করলে তাদের বলা হয়, কেন গ্রেফতার করছি তা তোমাদের বলতে পারব না। তবে উপর মহলের/বড়বাবুর চাপ রয়েছে গ্রেফতার করে না নিয়ে গেলে আমাদেরই চাকরি থাকবে না। তাই প্রশ্ন উঠেছে, নিহতদের গ্রেফতারের পিছনে পুলিশের কি এমন জরুরি প্রয়োজন ছিল? নিহত চারজনের বিরুদ্ধে যে কেস দেওয়া হয়েছে তাতে ধারা রয়েছে ৩৯৯ ও ৪০২। এর মধ্যে মূল হচ্ছে ডাকাতির উদ্দেশ্য কিংবা পরিকল্পনা।
পাবলিকের জানার ইচ্ছে, ধৃত ও পরে নিহত চারজনের মধ্যে আগে তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ ডাকাতি, ছিনতাই বা এই ধরনের কী কী কেস দিয়েছিল? যে চারজন সংখ্যালঘু যুবককে পুলিশ গ্রেফতার করেছে তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ একই ধরনের কেস দিয়েছে, ডাকাতির পরিকল্পনা। কিন্তু তাদের তো ধরা হল বাড়ি থেকে। এদের একজনের সঙ্গে অন্যজনের কোনও পরিচয় আছে বা ছিল, এমন কোনও খবর নেই। তারা একসঙ্গে সম্মিনিত হয়েছিল, পুলিশ সেই অভিযোগও করেনি। তাহলে কার সঙ্গে নিহত এই যুবকরা ডাকাতির পরিকল্পনা করেছিল? নাকি একা একা! তবে বাহাদুরি বলতে হবে বারুইপুর থানা ও বারুইপুর ডিস্ট্রিক্ট পুলিশের। তারা এই আলাদা আলাদা ব্যক্তিদের ডাকাতি করার পরিকল্পনার খবর পেয়ে গেল। আর মোক্ষম মুহূর্তে তাদের পাকড়াও করে ফেলল। একজন সম্পর্কে অবশ্য পুলিশ সামান্য একটি তথ্য দিয়েছে।
আবদুর রাজ্জাকের উপর সেই একই কেস, ৩৯৯ ও ৪০২ ভারতীয় দণ্ডবিধির ধারা প্রয়োগ করেছে। এফআইআর রিপোর্টে বলা হয়েছে, পুলিশ দেখে যে বারুইপুর পুলিশ স্টেশনের কাছে কাঁথাল বাইপাসের ধারে একটি নতুন তৈরি দেওয়ালের পাশে ১০ কিংবা ১২ জন লোক নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে কথা বলছিল। পুলিশ আবদুর রাজ্জাক ও আরও সাতজনকে ধারালো অস্ত্রশস্ত্র-সহ নাকি গ্রেফতার করে। অথচ রাজ্জাকের স্ত্রী বলছেন, তাঁর স্বামী আবদুর রাজ্জাককে পুলিশ বাড়ি থেকেই ধরে নিয়ে যায়। পুলিশ বাড়ির পিছনের দরজা দিয়ে প্রবেশ করে। কেন নিয়ে যাচ্ছেন, এই প্রশ্নের উত্তরে পুলিশ বলেছিল, ‘ওপর থেকে চাপ আছে, ধরে থানায় নিয়ে যেতে না পারলে চাকরি থাকবে না।’
সে যে বিহারে ব্যবসা করত, ঈদ-উল-আযহা উপলক্ষে গ্রামের বাড়িতে এসেছে সেই প্রমাণ হিসাবে ট্রেনের টিকিট দেখালে ছেড়ে দেওয়া হবে।
কিন্তু এখানে পুলিশ বলছে, রাজ্জাককে নাকি ফিসফিস করে কথা বলছে দেখে তারা পাকড়াও করে। প্রশ্ন, রাজ্জাককে কোথা থেকে ধরা হয়েছিল? ফিসফিস করেই কি শুধু ডাকাতিরই চক্রান্ত হয়? আগেই গ্রেফতারকৃত আবদুর রাজ্জাক কী করে কাঁথাল বাইপাসের ধারে পৌঁছল? বারুইপুর পুলিশ প্রযুক্তিগতভাবে কি এতটাই সমৃদ্ধ যে তারা ফিসফিস কথাকে ধারণ করে ‘ডিকোড’ করে ফেলল!
এনআইএ বা ‘র’ হাতেও হয়তো এত উন্নত প্রযুক্তি নেই, যা বারুইপুর ডিস্ট্রিক্ট পুলিশের হাতে রয়েছে! একই কথা প্রযোজ্য প্রথমে ধৃত ও পরে হত্যাকৃত বাকি সংখ্যালঘু যুবকদের ক্ষেত্রেও।
এখন সিআইডি তদন্তের ঘোষণায় পুলিশ একটু বেসামাল হয়ে রয়েছে। তবে তাদের যে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা তাতে সামাল দেওয়াটাও তাদের জন্য অসম্ভব নয়। পুলিশ এখন বলছে, নিহতদের দু’জন নাকি ছিল পাতাখোর ও ড্রাগ ব্যবসায়ী। ভালো কথা। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে যে ধারা দেওয়া হয়েছে তাতে অবশ্য পুলিশ ড্রাগের ধারা দিতে ভুলে গেছে! কথা হল, যদি পুলিশ এজন্যই তাদের ধরে থাকে তবে তাদের বিরুদ্ধে এফআইআর-এ ড্রাগ ব্যবসার ধারা কেন দেওয়া হল না? আদালতেও পুলিশ কেন এই ড্রাগ কথা বলল না? আর কেউ যদি ড্রাগে আসক্তও থাকে তবে তার শাস্তি থানায় বা জেলে পিটিয়ে মারা নয়। চিকিৎসকদের বক্তব্য, এই ধরনের ব্যক্তির বিশেষ চিকিৎসার প্রয়োজন।
জেলবন্দি নিহতদের বাড়ির লোকরা বলছে, জেল থেকে ফোন করানো হয়েছিল এই বলে যে, টাকা পাঠাও। তাহলে ভালো খাবার ও অন্য সুবিধা পাওয়া যাবে। স্বামীদের গলা ও তাদের আর্তি শুনে গরিব এই মানুষরা টাকাও পাঠিয়েছিল পেটিএম ও ফোনপে-র মাধ্যমে। এ সম্পর্কে তদন্ত হলে প্রমাণ লোপ করা সম্ভব নয়।
এই চার মুসলিম যুবকের মৃত্যুর পিছনে রয়েছে আরও অনেক ধোঁয়াশা। আর এই ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন বারুইপুর থানার পুলিশ কর্মী ও কর্তৃপক্ষ, রয়েছেন বারুইপুর কারারক্ষী ও কারা-কর্তৃপক্ষ, রয়েছেন হাসপাতালের সুপার, ডাক্তারদের রহস্যভরা ব্যবহার।
প্রথম কথা, সোশ্যাল মিডিয়ায় বারুইপুর ডিস্ট্রিক্ট পুলিশ যে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে চার সংখ্যালঘু যুবকের হত্যার ঘটনা চেপে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল, সেই সিদ্ধান্ত কে নিয়েছিল? কে তার বয়ান লেখে ও পোস্ট করে?
দ্বিতীয় কথা, বারুইপুর হাসপাতালে যখন পর পর কয়েকদিন একের পর এক পুলিশ ও কারা কর্তৃপক্ষের মতে ‘আহত’ পরিবার ও হাসপাতাল সূত্রের বক্তব্য অনুযায়ী ‘নিহত লাশ’ এবং একটি ক্ষেত্রে মুর্মুষু ব্যক্তিকে পাঠানো হয়। যে ডাক্তাররা ওই চার সংখ্যালঘু যুবকদের চিকিৎসা করেন, তাদের লিখিত প্রেসক্রিপশন কোথায়? বক্তব্য কী?
মৃত্যুর পর তারা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং পুলিশকে কী রিপোর্ট দিয়েছিলেন? এসবের কোনও হদিশ নেই। একজনের তো ঠিকমতো চিকিৎসাই হয়নি। পরিবারের অভিযোগ, হাসপাতালে ভর্তির বিষয়ে পরিবারের লোকজনকে কোনও খবর দেওয়া হয়নি। ২ আগস্ট পরিবারকে জানানো হয়। পরিবার বারুইপুর হাসপাতালে গিয়ে দেখে, বিনা চিকিৎসায় হাসপাতালের বাথরুমে উলঙ্গ অবস্থায় মূত্রের উপর ফেলে রাখা হয়েছে সাইদুলকে। তার সারাপিঠে মারের দাগ ছিল বলেও অভিযোগ।
চিকিৎসার জন্য তারা বারবার অনুরোধ করলেও কোনও কিছুই করা হয়নি। অবস্থা গুরুতর বলে ডাক্তার আইসিইউতে ভর্তি করতে নির্দেশ দিয়েছিল। সেই সময় বারুইপুর হাসপাতালে আইসিইউ বেড খালি ছিল না। পরিবরের অভিযোগ, তারা বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার কথা বললেও পুলিশ তা খারিজ করে দেয়। কিছুক্ষণ পর বিনা চিকিৎসায় সইদুল মুন্সির মৃত্যু হয়। সইদুল সম্পর্কে চিকিৎসকদের রিপোর্ট কী? এ ব্যাপারে কঠোর জিজ্ঞাসাবাদ হওয়া প্রয়োজন।
সব থেকে বড় কথা, নিহতের বাড়ির লোকজনদের কোনও ময়নাতদন্তের রিপোর্ট দেওয়া হয়নি। এই রিপোর্ট দেওয়া আইন ও মানবিকতা উভয় দিক থেকে জরুরী। বাড়ির লোকদেরকে শুধুমাত্র একটি স্লিপ ধরিয়ে দেওয়া হয় যে, নিহতের লাশের (ব্যক্তির নাম) ময়নাতদন্ত হয়ে গেছে। বাড়ির লোকদের বক্তব্য, তাদের বলা হয়, এটাই হচ্ছে ‘ময়নাতদন্তের রিপোর্ট’। কেন এই রকম করা হল? কার স্বার্থে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট গোপন করার চেষ্টা, তা জানা একান্তই জরুরি। সত্যিকারের তদন্ত হলে হয়তো এসব তথ্যের এবং অপরাধীদের কীর্তির জবাব পাওয়া যেত। স্পষ্টই অনেকে মনে করছেন, এই বিষয়ে কারা কর্তৃপক্ষ, বারুইপুর পুলিশ ও হাসপাতালের মধ্যে একটি ঘনিষ্ঠ যোগসূত্রের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। এ ধরনের আরও অসংখ্য প্রশ্ন রয়েছে। সেই প্রশ্নগুলিরও জবাব পাওয়া জরুরি।