পুবের কলম প্রতিবেদক: আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে কলকাতার দেশপ্রিয় পার্কের সরকারি অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও বহু বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীর সামনে চিত্রশিল্পী শুভাপ্রসন্ন বাংলা ভাষায় ‘পানি’, ‘দাওয়াত’-এর মতো শব্দ প্রবেশের বিরোধিতা করেছেন।
একে তিনি ‘সাম্প্রদায়িক ছাপ’ হিসেবে দেগে দিয়েছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শিক্ষাবিদ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি তৎক্ষণাৎ এর বিরোধিতা করে ভাষার বহমানতার দিকটি তুলে ধরেন। তখনকার মতো মঞ্চে বিষয়টি থেমে গেলেও বিতর্কের জল বা পানি গড়াতে শুরু করে। পুরনো সমালোচনা, প্রশ্ন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। মুসলমানরা কি বাঙালি নন, এ নিয়েও আলোচনা শুরু হয়।
কলকাতার সাংস্কৃতিক জগৎ ছাড়িয়ে বিদেশের পত্রপত্রিকাতেও ভাষা-বিতর্ক নিয়ে লেখালেখি হচ্ছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রথম সারির মিডিয়াগুলি এ নিয়ে খবর করেছে। জার্মানির ‘ডয়চে ভেলে’র বাংলা সংস্করণেও এ নিয়ে বিশদ প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। ‘ডয়চে ভেলে’ এ বিষয়ে তাদের খবরের শিরোনাম করেছে ‘পশ্চিমবঙ্গে পানি নিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত বিতর্ক’।
‘ঢাকা টাইমস’ লিখেছে- ‘দাওয়াত’ ও ‘পানি’র পক্ষে মমতা, বললেন আমি মাতৃভাষাকে চেঞ্জ করতে পারি না। বাংলাদেশের প্রথম সারির পত্রিকা ‘কালের কণ্ঠ’ও এ নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাদের শিরোনাম- বাংলায় ‘পানি’ ও ‘দাওয়াত’ শব্দ ঢোকা নিয়ে বিতর্ক, যা বললেন মমতা। ‘সমকাল’ পত্রিকা লিখেছে- বাংলা ভাষা নিয়ে শুভাপ্রসন্নের ভাবনাকে ‘সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি’ বললেন মমতা। এভাবেই ওপার বাংলা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সরব হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়াতেও বিতর্কের ঝড়। বাংলাদেশের বিশিষ্ট লেখকদের মত, কলকাতার আধিপত্য বজায় রাখার জন্য এভাবে বাংলা ভাষায় বিভাজন রেখা টেনে দিচ্ছেন কেউ কেউ। প্রশ্ন উঠছে, দুই বাংলা মিলিয়ে মুসলমানদের সংখ্যা বেশি। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছে মুসলিমরা। তারপরও শুভাপ্রসন্ন এমন মন্তব্য কেন করলেন?
অনেকেই শুভাপ্রসন্নের উসকানিমূলক মন্তব্যের উত্তর দিতে গিয়ে অভিধানের আশ্রয় নিচ্ছেন। পানি যে আদতে সংস্কৃত শব্দজাত চর্যাপদেও ছিল, অথবা বাংলা অভিধানে আরবি, ফারসি ইত্যাদি ভাষা থেকে কত শব্দ এসেছে, সেসব নিয়ে তথ্যবহুল প্রতিবাদ করছেন। শুভাপ্রসন্ন নিজেও ওই তথ্যগুলো জানেন। এত সাধারণ ও সহজলভ্য তথ্য ওঁর না জানার কথা নয়।
অভিযোগ, এসব আলটপকা উচ্চারণ আসলে এক বৃহত্তর রাজনীতির অংশ, যে রাজনীতি সংখ্যালঘুকে ‘অপর’ করে তোলে। প্রবীণ চিত্রকর শুভাপ্রসন্ন তাঁদের সম্পর্কে যে ‘অপমানজনক’ ভাষা ব্যবহার করেছেন, তাতে ক্ষুব্ধ বুদ্ধিজীবী নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি এবং সুবোধ সরকার। তাঁরা এ বিষয়ে মুখ না খুললেও প্রাবন্ধিক এবং কবি ইতিমধ্যেই বিষয়টি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে জানিয়েছেন বলে তাঁদের ঘনিষ্ঠ সূত্রের খবর। তবে মমতা ওই বিষয়ে কী বলেছেন, তা জানা যায়নি। কুণাল ঘোষও এর বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন। চিত্রশিল্পীর পুরনো দুর্নীতির ইতিহাস ঘাঁটতে দেখা যাচ্ছে অনেককে। বাঙালি বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিকরা খারিজ করেছেন শুভাপ্রসন্নর বক্তব্য। তা সত্ত্বেও চিত্রশিল্পী নিজের অবস্থানে অনড় রয়েছেন।
শুভাপ্রসন্ন এ ব্যাপারে বলেন, রবীন্দ্রনাথ লক্ষ লক্ষ বাংলা শব্দ ব্যবহার করেছেন। কিন্তু গোসল, পানি, দাওয়াত লিখেছেন কি? বিবেকানন্দ বলেইছিলেন, শান্তিপুর-ঢাকাকে নিয়ে কলকাতার ভাষাই হবে মান্য। ফলে পণ্ডিতরা যাই বলুন, একটি সম্প্রদায়ের ভাষা দিয়ে আমরা চিহ্নিত হতে চাই না।
এ প্রসঙ্গে সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের মন্তব্য, বাংলাদেশে সবাই পানি, দাওয়াত বলেন। এই শব্দগুলি সে দেশে গৃহীত হয়েছে। এতে কোনও সমস্যা নেই। অন্য ভাষার শধকে আপন করে নেওয়া যেতেই পারে। সাহিত্যিক অমর মিত্র জানাচ্ছেন, বাঙালি মানে তো শুধু হিন্দু নয়, মুসলমানও আছে। ভারতের অবাঙালি হিন্দু-মুসলমান সকলেই পানি বলে। যদি ইনভাইট করছি বলতে আপত্তি না থাকে, তা হলে দাওয়াতে আপত্তি কেন? এই যে রিকশায় চেপে যাচ্ছি, রিকশা কি বাংলা শব্দ
এই বিতর্কে দুই বাংলার কোনও বিদ্বজ্জনকে পাশে পাননি শুভাপ্রসন্ন। শুধু বাংলাদেশ নয়, পশ্চিমবঙ্গের প্রায় ৩০ শতাংশ মুসলমান জনতাও ‘পানি’ শব্দ ব্যবহার করেন। তাই শুভাপ্রসন্নর বক্তব্য রাজনৈতিকভাবে ভিন্ন অভিঘাত রাখে, এ কথা বলাই যায়। এই মন্তব্যে আরও বড় বিপদের গন্ধ পাচ্ছেন অসম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য তপোধীর ভট্টাচার্য।
তিনি বলেন, শ্রীহট্টে আমাদের মতো হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারের একাংশে পানি বলার রেওয়াজ ছিল। তাতে কি এসে গিয়েছে বাঙালিকে হিন্দু ও মুসলমানে ভাগ করার রাজনৈতিক চেষ্টা হচ্ছে। এসব যাঁরা বলছেন, তাঁরা বাঙালির শত্রু।