পুবের কলম প্রতিবেদক: মঙ্গলবার আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তালতলা ক্যাম্পাসে ইসলামিক থিয়োলজি বিভাগ থেকে এমএ ডিগ্রির সমতুল মুমতাজুল মুহাদ্দিসিন বা এমএম পাশ পড়ুয়াদের পাগড়ি প্রদান, মহিলাদের হিজাব প্রদান ও স্মারক সম্মাননার অনুষ্ঠান ছিল। সেই অনুষ্ঠানে আলিয়ার ২০১৯, ২০২০ ও ২০২১ শিক্ষাবর্ষে এমএম উত্তীর্ণ পড়ুয়াদের বিদায় সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সাধারণ পড়ুয়াদের আয়োজিত ওই অনুষ্ঠানে বিভাগীয় অধ্যাপক-অধ্যাপিকা, ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য, নিবন্ধক, সহ-নিবন্ধক ও বহু বিশিষ্টজন উপস্থিত ছিলেন। মুসলিম সমাজে দ্বীন ও দুনিয়ার শিক্ষা বিস্তারে আলিয়া মাদ্রাসা, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা এবং সাম্প্রতিক সময়ের প্রেক্ষিতে করণীয় বিষয়েও আলোচনা করেন বিশিষ্টরা।
এ দিনের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত বিশেষ অতিথি পুবের কলম-এর সম্পাদক ও সাবেক সাংসদ আহমদ হাসান ইমরান সমাজ গঠনে নারীদের ভূমিকা ও সাম্প্রতিক নানান ইস্যু নিয়ে আলোকপাত করেন। এ দিনের অনুষ্ঠান সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, আমাদের মেয়েরাও থিয়োলজি বিষয়ে শিক্ষা সম্পন্ন করছে, এটা আনন্দ ও গর্বের। তিনি আরও বলেন, দ্বীন ও দুনিয়াবি শিক্ষায় নারীদের অগ্রসরতা মুসলিম সমাজে দিশা দেখাবে।
এ প্রসঙ্গে আরবি প্রবাদ উদ্ধৃত করে ইমরান বলেন, প্রত্যেক মা হচ্ছে এক একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। যে মুসলিম সমাজে মেয়েরা দ্বীন ইসলাম ও লেখাপড়া থেকে দূরে থাকবেন যে মুসলিম সমাজে মেয়েদের মধ্যে নারীদের ইসলামি চেতনা থাকে না সেই সমাজে কখনোই ইসলামের শক্ত শিকড় থাকতে পারে না। দ্বীনদার মহিলারাই সমাজের কাণ্ডারি।
বর্তমান সময়ে নবী সা.-কে নিয়ে ও হিজাব সম্পর্কে যে অপ্রচার ও বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে, সে-সম্পর্কেও আলোকপাত করেন আহমদ হাসান ইমরান। তিনি বলেন, নবী সা. হচ্ছেন ইসলামের অন্যতম মূল ভিত্তি। তাঁর চরিত্র, তাঁর সুন্নাহ ও তাঁর সীরাত আমাদের পথপ্রদর্শক।
কর্নাটকে হিজাব পরিহিতা মেয়েদের পরীক্ষা দিতে দেওয়া হচ্ছে না কিন্তু তাঁরা হিজাব ছাড়েননি। হিজাব-বিরোধীদের সামনে ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি দিয়ে একাই প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন মুসকান নামের একটি মেয়ে। এভাবেই ইসলামকে আঁকড়ে ধরে সত্য ও শান্তির পথে সবাইকে থাকতে হবে বলেও উল্লেখ করেন ইমরান। নবী সা. সম্পর্কে অপপ্রচার রুখতে নবী সা.-র জীবনী ছোট ছোট পুস্তিকা ও লিফলেট তুলে ধরতে হবে। হিন্দু ভাইদের কাছে ইসলামের আদর্শ তুলে ধরলে বিভেদ-বিভাজন কমবে বলেই মনে করেন আহমদ হাসান ইমরান।
অন্যদিকে আলিয়ার ঐতিহ্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে আহমদ হাসান ইমরান বলেন, এক সময় আলিয়াতে লাহো, পটনা, কানপুর, দিল্লি থেকে ছাত্র ও অধ্যাপকরা আসতেন। তিনি আরও বলেন, শিক্ষার শেষে যাদেরকে পাগড়ি প্রদান করা হল, আর যে নারী পড়ুয়ারা সম্মাননা স্মারক পেলেন তাঁদের কর্তব্য, মুসলিম সমাজ ও বাংলার সমাজকে সঠিক পথে চালিত করার জন্য চেষ্টা করা।
এ দিন আলিয়ার ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য ড. আবু তাহের কমরুদ্দিন তৎকালীন আলিয়া মাদ্রাসা থেকে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে উত্তীর্ণ হওয়ার দীর্ঘদিনের ইতিহাস তুলে ধরেন। ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি কীভাবে আলিয়ায় আধুনিক শিক্ষা প্রদানের মিশেল ঘটেছে, তা তুলে ধরেন।
তিনি জানান, ইংরেজ আমলে আলিয়া মাদ্রাসা থেকে ফেকাহ্ পাশ পড়ুয়াদের দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালতের বিচারক পর্যন্ত নিয়োগ করা হত। প্রায় ২০০ বছর আগে আলিয়াতেই প্রথম পরীক্ষা গ্রহণ পদ্ধতি চালু হয়। শুধু তাই নয়, ভর্তির জন্য প্রবেশিকার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল সেই সময়। আলিয়ায় মেডিক্যাল শিক্ষা থেকে শুরু করে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার আরও নানান দিক তুলে ধরেন আবু তাহের কমরুদ্দিন।
আলিয়ার রেজিস্টার ড. নুরুস সালাম বিদায়ী পড়ুয়াদের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনারা এমন কাজ করবেন, যাতে সমাজে দৃষ্টান্ত হতে পারে। আপনাদের মাথায় পাগড়ি দেওয়া হল, মেয়েদের হিজাব দেওয়া হল, এটা হল একপ্রকার ভ্যাকসিন। আমরা মনে করব আপনাদের দ্বারা দেশ ও সমাজের জন্য ভালো কাজ হবে। মেয়েদের শিক্ষা বিষয়েও তিনি মতামত ব্যক্ত করেন।
এই সভায় উপস্থিত হন পীরজাদা ত্বহা সিদ্দিকী। তিনি বলেন, আল্লাহর নবী সা. ও ইসলাম সবসময় শিক্ষার কথা বলেছেন। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা অন্য কোনও ক্ষেত্রে শিক্ষা নিতে বাধা নেই। পীরজাদা ত্বহা সিদ্দিকী বলেন, আল্লাহর নবী সা. বলেছেন চিন দেশে গিয়েও শিক্ষা গ্রহণ কর। তবে দ্বীনি শিক্ষার উপর আমাদের জোর দিতে হবে। তাহলে ছাত্রছাত্রীরা চরিত্রবান হবে।
অন্যদিকে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্টার আসফাক আলি, ইসলামিক থিয়োলজি বিভাগের প্রধান মুহাম্মদ ইমদাদুল, অধ্যাপক সেখ সাইফুদ্দিন, সামিম আখতার, মুফতি লিয়াকত, মারুফা খাতুন, তারেক আলি, রাহিলা পারভীন, সাফুরা খাতুন, মেহেরুন নিশা, মেহেদি হাসান প্রমুখ আলিয়ার পড়ুয়াদের আগামী দিনের মঙ্গল কামনা করেন।
এ দিনের অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের তরফে রাকিবুল হক জানান, ২০১৯ সালে এমএম উত্তীর্ণ ১২ জন মহিলা-সহ মোট ৮০ জন, ২০২০ সালের ১ জন মহিলা-সহ মোট ৪৮ জন ও ২০২১ সালের ৮২ জন পুরুষ ও ২৭ জন মহিলা মিলিয়ে ১০৯ জন পড়ুয়াকে সংবর্ধিত করা হয়। পুরুষ ও মহিলা উভয়কেই স্মারক, উত্তরীয়, মানপত্র দেওয়া হয়। পুরুষ পড়ুয়াদের পাগড়ি ও মহিলাদের হিজাব প্রদান করা হয়।
উপাচার্য আবু তাহের কামরুদ্দিন-সহ কর্তৃপক্ষের কাছে ছাত্রনেতা আবদুল রাকিব আবেদন করেন, এরপরের বছর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় নিজেই যেন এই পাগড়ি প্রদান অনুষ্ঠান করে। এ বছর করেছে ছাত্রছাত্রীরা।