বাংলাদেশে কিছু হলেই তসলিমা নাসরিন মুখ খোলেন। কিন্তু বহু বছর তিনি মোক্ষম মওকা পাচ্ছিলেন না। এবার বাংলাদেশে দুর্গাপুজোর সময় দুঃখজনক কিছু ঘটনায় তসলিমা সেই সুবর্ণসুযোগ হাতে পেয়েছেন। আর তাতেই কোনওরকম বাছবিচার না করে তিনি বাংলাদেশ সম্বন্ধে তাঁর যে তিন যুগ লালিত থিওরি রয়েছে– তা উগরে দিয়েছেন সংবাদসংস্থা পিটিআই-এর কাছে।
বাংলাদেশে হিন্দু বিরোধী হিংসার ঘটনায় ক্ষুব্ধ ভারতে আশ্রিত বিতর্কিত লেখিকা তসলিমা নাসরিন। তিনি শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লিগ সরকারের বিরুদ্ধে তোপ দেগে বলেছেন, বাংলাদেশ এখন ‘জিহাদিস্তান’হয়ে উঠেছে। মাদ্রাসাকে মৌলবাদের প্রজননক্ষেত্র বলে দেগে দিয়েছেন তিনি। শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে ধর্মকে রাজনৈতিক লাভের জন্য ব্যবহার করার অভিযোগও এনেছেন ‘লজ্জা’র লেখিকা। তিনি বলেন– বাংলাদেশে হিন্দু ও বৌদ্ধরা ‘তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক’ হয়ে উঠেছে এবং ক্রমবর্ধমান হিন্দু বিরোধী মানসিকতা উদ্বেগজনক।
বাংলাদেশে হিন্দু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হামলা ও মন্দির ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে সম্প্রতি। গত সপ্তাহে কুমিল্লার একটি দুর্গাপুজো ভেন্যুতে ধর্মদ্রোহিতার একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়ায় যা বেশকিছু জেলায় সংঘর্ষ ঘটিয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে। হামলার নিন্দা করে লেখিকা একটি সাক্ষাৎকারে বলেন, আমি আসলে এটাকে আর বাংলাদেশ বলতে পছন্দ করি না। এটি এখন ‘জিহাদিস্তান’ হয়ে গেছে। বর্তমান সরকারসহ পূর্ববর্তী সকল সরকার ধর্মকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছে। তারা ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম বানিয়েছে, তাই হিন্দু ও বৌদ্ধরা তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে গেছে এবং এইরকম নিপীড়নের শিকার হয়েছে। তাকে বাংলাদেশে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না কেন– তা নিয়ে এর আগেও আওয়ামী লিগ সরকারের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন তসলিমা। ইসলাম বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গির জন্য ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ ত্যাগ করতে হয়েছিল তাকে। এরপর একাধিকবার তিনি দেশে ফেরার চেষ্টা চালিয়েছেন। কিন্তু কোনও সরকারই তাতে কর্ণপাত করেনি। তবে দেশে না ফিরতে পারলেও জন্মভূমির হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক নিয়ে গরম গরম মন্তব্য করে বিতর্ক ছড়ানোর চেষ্টা করেন তিনি। এ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় আক্রমণের সম্মুখীনও হয়েছেন। তবে তাতে দমে যাবার পাত্রী নন তসলিমা। ফের শেখ হাসিনা সরকারকে একহাত নিয়েছেন সোশ্যাল মিডিয়াতেও।
সাক্ষাৎকারে তসলিমা আরও বলেন– বাংলাদেশে হিন্দু বিরোধী মনোভাব নতুন নয় এবং এটা অদ্ভুত যে দুর্গাপুজো উৎসবের সময় হিন্দুদের কোনও সুরক্ষা দেওয়া হয়নি।
শেখ হাসিনা খুব ভালোভাবেই জানেন যে প্রতি বছর দুর্গাপুজোর সময় সেখানে ‘জিহাদি’আক্রমণের সুযোগ থাকে হিন্দুদের উপর। তাহলে হিন্দু সংখ্যালঘুদের কেন কোনও সুরক্ষা দেওয়া হয়নি? এভাবেই প্রশ্ন তুলেছেন বিতর্কিত লেখিকা। অনেক হিন্দু এখন দেশ ছেড়ে চলে যাবে এই আশঙ্কায় তিনি বলেন– সরকার যদি তাদের রক্ষা করতে চায় তাহলে তা আগেই করতে পারত।
তার বই ‘লজ্জা’ বাংলাদেশে নিষিদ্ধ। এ প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন– আমি আমার উপন্যাস ‘লজ্জা’ ১৯৯৩ সালে লিখেছিলাম যেখানে একটি হিন্দু পরিবার মুসলিম ধর্মান্ধদের হাতে আক্রান্ত হয় এবং দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু এমন ঘটনা কেবল ১৯৯৩ সালে ঘটেছিল এমন নয়। এটা ধারাবাহিকভাবে চলছে। হিন্দুরা মুসলমানদের হাতে নির্যাতিত– নিপীড়িত এবং হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। এটা বছরের পর বছর ধরে চলছে। মুসলমানরা চায় হিন্দুরা দেশ ছেড়ে চলে যাক যাতে তারা তাদের জমি দখল করতে পারে।
১৯৯২ সালে ভারতে বাবরি মসজিদ ভাঙার পরপরই বাংলাদেশের কিছু অংশে হিন্দুবিরোধী দাঙ্গার জন্য ‘লজ্জা’ বইটিকে লেখকের প্রতিক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করা হয়। নারী– মানবাধিকার এবং ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে তার লেখার জন্য পরিচিত তসলিমা দাবি করেছেন– মাদ্রাসা ও মসজিদ বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মকে ব্রেইনওয়াশ করার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। এভাবে এই দেশটিও তালিবান নিয়ন্ত্রিত আরেকটি আফগানিস্তানে পরিণত হচ্ছে। দেশছাড়ার যন্ত্রণা তসলিমা এখনও ভুলতে পারেননি। তাই যেকোনও বিষয়ে বলতে গেলে শেষে তিনি ওই হৃদয়বিদারক ঘটনাটি টেনে আনেন।
এদিনও নাসরিন বলেন, আমি সারা জীবন চরমপন্থার শিকার হয়েছি। কারণ আমার লেখা নারী ও মানবিকতা নিয়ে। আমাকে দেশ থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে ২৮ বছর হয়ে গেছে এবং এখনও কোনও সরকার আমাকে দেশে প্রবেশের অনুমতি দেয়নি। আমি ২৮ বছর আগে ‘লজ্জা’তে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পক্ষ নিয়ে লিখেছি এবং এখনও লিখি যখন বিশ্বের যেকোনও স্থানে এই ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। সেটা বাংলাদেশ– পাকিস্তান– আফগানিস্তান– সিরিয়া বা বিশ্বের যেকোনও স্থান হতে পারে। নাসরিন মনে করেন ধর্মীয় সহনশীলতা না থাকলে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি অর্থহীন।
তিনি বলেন, মাদ্রাসাগুলো সরকার নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিত এবং তারা যা শিক্ষা দিচ্ছে সে বিষয়ে কঠোর নজরদারি থাকা উচিত। শিশুদের ধর্মনিরপেক্ষ স্কুলে যেতে উৎসাহিত করা উচিত এবং তাদের অবশ্যই বৈজ্ঞানিক মানসিকতার অধিকারী হতে হবে। বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর হামলার বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ সমাবেশ সম্বন্ধে তিনি বলেন, আমি খুবই আনন্দিত যে শত শত মানুষ এই ঘটনার বিরুদ্ধে চট্টগ্রামে একটি প্রতিবাদ সমাবেশে অংশ নিয়েছে যেখানে প্রগতিশীল মুসলমানরাও অংশ নিয়েছিল। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে মিডিয়া ব্ল্যাকআউট হওয়ায় সোশ্যাল মিডিয়া এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে।