পারিজাত মোল্লা: মেয়ের বিবাহ হয়ে গেলে সেই মেয়ের অধিকার কি থাকে বাপের বাড়িতে? বিবাহিতা মেয়েরা কি পিতার পরিবারের সদস্য নন? তা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা সবসময়ই । সেই বিষয়টি স্পষ্ট করল কলকাতা হাইকোর্ট এর ডিভিশন বেঞ্চ। বিবাহিত মহিলাও যে তার পিতার পরিবারের সদস্য সেই বিষয়ে সিলমোহর দিল ডিভিশন বেঞ্চ। রাজ্য সরকারের কাছে জমির ক্ষতিপূরণের দাবি সংক্রান্ত একটি মামলায় কলকাতা হাইকোর্টের সিঙ্গেল বেঞ্চ জানিয়েছিল বিবাহিতা মহিলা তার পিতার পরিবারের সদস্য।বিবাহিত মেয়ে বাবার সম্পত্তির অংশীদার। তাহলে বাবার মৃত্যুর পর তিনি কেন পরিবারের সদস্য নন? এই যুক্তিতেই খারিজ হয়ে গেল রাজ্য সরকারের নির্দেশিকা।
হাইকোর্টের ওই রায়ের পরই বিবাহিত এক মহিলার চাকরি পাওয়ার পথ অনেকটাই সুগম হল বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। আদালত সুত্রে প্রকাশ, বীরভূমের বাসিন্দা রেখা পাল তার বাবার সম্পত্তি বক্কেশ্বর তাপবিদ্যুত্ প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণ করে রাজ্য সরকার। গত ১২ অক্টোবর ২০১২ সালে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে একটি নির্দেশিকা প্রকাশ করা হয়। সেই নির্দেশিকা অনুসারে বিশেষ ছাড়ের কোটাতে চাকরির আবেদন জানান রেখা পাল। বাবার সম্পত্তির ক্ষতিপূরণ হিসেবে রেখা দেবী চাকরির আবেদন জানান।রেখার ওই আবেদনের পর রাজ্য সরকার তার আবেদন খারিজ করে দেয়। কারণ কী?
রাজ্য সরকারের যুক্তি হল, রেখা পাল বিবাহিত। তাই তিনি বিশেষ কোটায় চাকরি পাওয়ার উপযুক্ত প্রার্থী নন। এদিকে বাবার মৃত্যুর পর থেকেই তার বিধবা মায়ের দেখাশোনার দায়-দায়িত্ব তিনিই পালন করে আসছেন।রাজ্য সরকারের প্রকাশিত নির্দেশিকাকে চ্যালেঞ্জ করে ২০১৩ সালে কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন রেখা দেবী। তৎকালীন বিচারপতি অশোক দাস অধিকারী ২০১৪ সালে রাজ্য সরকারের অসংবিধানিক নির্দেশিকা খারিজ করে দেন। পাশাপাশি রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দেন রেখা পালকে পরিবারের সদস্য হিসাবে ঘোষণা করার। এবং তাকে বিশেষ কোটায় অন্তর্ভুক্ত করারও নির্দেশ দেন। জমিহারা হিসেবে বিশেষ কোটায় চাকরি পাওয়ার যোগ্য হিসেবে রায় দেন বিচারপতি।সেই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে রাজ্য সরকার ডিভিশন বেঞ্চে দ্বারস্থ হয় দীর্ঘ ১০ বছর কলকাতা হাইকোর্টের বিভিন্ন এজ্লাস ঘুরে অবশেষে মামলা আছে বিচারপতি দেবাংশু বসাকের ডিভিশন বেঞ্চে।
মামলাকারী রেখা পালের পক্ষের আইনজীবী আশীষ কুমার চৌধুরী ওই রায় নিয়ে বলেন, -‘ কেন বিবাহিত মেয়ে তার পিতার পরিবারের সদস্য বলে গন্য করা হবে না? যদি পুত্র/বিধবা/ বিবাহ বিচ্ছিন্ন /মেয়েরা পরিবারের সদস্য হয়। তাহলে বিবাহিত মেয়েরাও তার পিতার পরিবারের সদস্য। তাই রাজ্যের নির্দেশিকা অসাংবিধানিক। রাজ্য সরকার লিঙ্গ বৈষম্যের কারণ দেখিয়ে পুত্র/কন্যা /বিধবা এবং বিবাহ বিচ্ছেদ দেখিয়ে কাউকে এভাবে তার সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারে না’। কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি দেবাংশু বসাক ও বিচারপতি সাব্বির রশিদির ডিভিশন বেঞ্চ রাজ্য সরকারের দীর্ঘ সুত্রতা ও মামলা ঝুলিয়ে রাখার জন্য মামলাটি খারিজ করে দেন।ডিভিশন বেঞ্চও একক বেঞ্চের সেই রায়কেই বহাল রাখল। এই মামলায় সরকার পক্ষের কেউ হাজির না হওয়ায় চলতি সপ্তাহে বিচারপতি দেবাংশু বসাক ও বিচারপতি মহম্মদ শব্বর রশিদির ডিভিশন বেঞ্চ রাজ্যের আবেদন খারিজ করে দিয়েছে।হাইকোর্টে ক্ষতিপূরণের দাবিতে মামলা করেছিলেন রেখা পাল নামে এই মহিলা। তিনি বিবাহিতা।
মামলা সূত্রে জানা গিয়েছে, বক্রেশ্বর তাপবিদ্যুত্ প্রকল্পের জন্য জমি রাজ্য অধিগ্রহণ করেছিল রাজ্য সরকার । ২০১২ সালের অক্টোবরে রাজ্যের শ্রম দফতরের তরফে বিজ্ঞপ্তি জারি করে জানানো হয়েছিল, যে পরিবারগুলির জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে তারা ক্ষতিপূরণের জন্য আবেদন জানাতে পারবেন। ওই প্রকল্পের জন্য রেখার বাবার জমিও অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। তাই তিনিও ক্ষতিপূরণ হিসেবে চাকরির জন্য আবেদন জানিয়েছিলেন। কিন্তু, রাজ্য সরকার তার আবেদন খারিজ করে দিয়েছিল।
রাজ্যের শ্রম বিভাগের তরফে জানানো হয়েছিল, এই বিজ্ঞপ্তিতে বিবাহিতা মেয়েদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। রেখা যেহেতু বিবাহিতা তাই তার আবেদন খারিজ করা হয়েছে। ফলে চাকরির জন্য আবেদন করতে পারবেন না। উল্লেখ্য, রেখা বিবাহিতা হলেও বাবার মৃত্যুর পর মায়ের দেখাশোনা করেছেন।রাজ্য সরকারের এই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে ২০১৩ সালের কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন রেখা পাল। তার আইনজীবী আশিস কুমার চৌধুরী হাইকোর্টে রাজ্য সরকারের এই সিদ্ধান্তকে অসাংবিধানিক বলে উল্লেখ করেন। তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন যদি বিধবা বা বিবাহ বিচ্ছিন্না মহিলা তার পিতার পরিবারের সদস্য হতে পারেন তাহলে কেন একজন বিবাহিতা মহিলা তার পিতার পরিবারের সদস্য হতে পারবেন না? একই সঙ্গে তিনি কেন পৈতৃক সম্পত্তি পাবেন না? তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন আইনজীবী।
সেই সংক্রান্ত মামলায় বিচারপতি অশোক কুমার দাস অধিকারী বলেছিলেন, ‘শুধুমাত্র লিঙ্গের ভিত্তিতে বিবাহিত কন্যা এবং বিবাহিত পুত্রের মধ্যে পার্থক্য বা বৈষম্য তৈরি করা যায় না।’ এরপরে কলকাতা হাইকোর্টের সিঙ্গেল বেঞ্চ ওই মহিলাকে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দিয়েছিল। তবে সেই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে ডিভিশন বেঞ্চে যায় রাজ্য সরকার। তাই ১০ বছর ধরে মামলা চলার পর গত শুক্রবার দুই বিচারপতির বেঞ্চ রাজ্য সরকারের আবেদন খারিজ করে সিঙ্গেল বেঞ্চের রায়কেই বহাল রাখে।এতে ওই মহিলার চাকরির পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়লো বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল।