মেহবুবা মুফতি সাবেক জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যের শেষ মুখ্যমন্ত্রী। বর্তমানে তিনি পিডিপি সভাপতি। কাশ্মীরের বর্তমান পরিস্থিতি, বিজেপি সঙ্গে জোট বেঁধে শাসন ক্ষমতায় আসা, আশাভঙ্গ—এসব নিয়ে তাঁর খোলামেলা মতামত ব্যক্ত করেছেন এই সাক্ষাৎকারটিতে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন দ্য টেলিগ্রাফের সাংবাদিক সঙ্কর্ষণ ঠাকুর
প্রশ্নঃ এক সময়ের রাজ্য জম্মু ও কাশ্মীরের শেষ মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে আপনার নাম ইতিহাসে স্থায়ী হয়ে আছে। বিজেপির সঙ্গে জোট বেঁধে ক্ষমতায় আসার সময় থেকে পিছনের বছরগুলিকে আপনি কীভাবে দেখেন? রাজ্যের মর্যাদা হরণ ও ৩৭০ ধারা বাতিল হওয়ার পর আপনার ভাবনা কী?
উত্তরঃ আমার কিছু বলার নেই। কীই বা বলতে পারি বলুন? কাশ্মীরিদের স্বজনহারা করা হয়েছে। আমাদের সঙ্গে যা করা হয়েছে তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে আমার শব্দভাণ্ডারে এই শব্দ ছাড়া আর কিছু নেই। আমাদের নিয়ে কারও মাথাব্যথা আছে, ২০১৮ সালের পর বিজেপি সমর্থন তুলে নেওয়ার পর থেকে এটা লাগাতার ঘটে চলেছে। ওই সময় থেকেই তারা গণতন্ত্রকে ভিন্নপথে চালিত করতে শুরু করেছিল। কিন্তু, এ নিয়ে কারও কিছু আসে যায় না। জাতীয় স্বার্থের নাম করে আপনি কাশ্মীরে খুন করতে পারেন। এই কাজ এখানে খুবই স্বাভাবিক।
২০১৯ সালের ৫ আগস্ট ছিল কাশ্মীরিদের ছেঁটে ফেলার শুরুয়াত। তাদের পোশাক, তাদের আত্মমর্যাদাসহ যা কিছু তাদের ছিল, সব। তারপর থেকে পরিস্থিতি খারাপ থেকে খারাপতর হয়েছে। কাশ্মীরিদের এই ক্ষয় রোধ করার কেউ নেই। কিছু নেই। কেন্দ্রের চেয়ে কাশ্মীরে অনেক বেশি সংস্থা রয়েছে। স্থানীয় গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা সংস্থা। তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলে, কে বেশি কাশ্মীরিদের হয়রান ও হেনস্থা করতে পারে তা নিয়ে। পাসপোর্ট রাখার মৌলিক অধিকার এখন বিলাসিতায় পরিণত হয়েছে। এটা শুধু আমার বা আমার মা বা আমার বোনের ব্যাপার নয়। তারা যদি এটা আমার সঙ্গে করতে পারে তাহলে বাকি কাশ্মীরিদের সঙ্গে কেমন আচরণ করা হচ্ছে ভেবে দেখুন। আমার ৭৫ বছর বয়সী মাকে পাসপোর্ট দেওয়া হয়নি জাতীয় স্বার্থের নাম করে। তিনি ছিলেন ভারতের প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রয়াত মুফতি মহম্মদ সাইদের স্ত্রী। এবার ভাবতে পারছেন সাধারণ তরুণ-তরুণী কাশ্মীরিদের কী অবস্থা। তারা হয়ত বিদেশ পড়তে যেতে চায়। কিন্তু পারছে না। উপত্যকায় সাংবাদিকদের সঙ্গে কী হচ্ছে জানেন? এখানে সাংবাদিকতা অবশিষ্ট নেই। রাজ্যের বাইরে অনেক তরুণ জেলে পচছে। তাদের দেখতে যাওয়ার মতো উপায় নেই তাদের অভিভাবকদের। কোনও শুনানি নেই। কাশ্মীর যদি স্বাভাবিক হয় এবং ২০১৯ সালের ৫ আগস্টের পর একটাও ঢিল যদি ছোঁড়া না হয় তাহলে কেন এই ধরপাকড়, কেন এতজন জেলে? কাশ্মীরের উপর অত্যাচারে তারা ইসরাইলি মডেল নিয়েছে।
ইসরাইল গাজা ও ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে যা করছে, দিল্লি এখানে তাই করছে। আমাদের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। আমাদের ক্ষমতাশূন্য করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি কী আঘাত করে জানেন? দেশের বাকি অংশে আমাদের যন্ত্রণা নিয়ে উদযাপন করা হয়। মিষ্টি বিতরণ করা হয়।?
প্রশ্নঃ বিজেপির সঙ্গে জোট বাঁধা কি একটা ভুল, একটা রাজনৈতিক ত্রুটি ছিল না?
উত্তরঃ বৃহত্তর ধারণাকে মাথায় রেখে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। হয়ত সেটা ভুল ছিল। মুফতিসাহেব সব সময় আমাকে বলতেন, মেহবুবা, ভারত হাতির মতো কিন্তু কাশ্মীর তাদের বিচ্ছিন্নতার কারণে ভারতকে পিছন থেকে টানছে। বিশেষ করে ১৯৯০-এর দশকে যখন বন্দুক ও জঙ্গিবাদ এল। কাশ্মীরিরাও ভুগেছে। তাই তিনি একটা পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। পাকিস্তানের সঙ্গে বোঝাপড়ার জন্য বাজপেয়ীসাহেবকে বোঝাতে তিনি সক্ষম ছিলেন। দুই দেশের মধ্যে কথা হয়। ২০০২-২০০৫ সাল কাশ্মীরের সেরা সময়।
এই সময়ে মুফতিসাহেব কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। প্রথমে বিজেপির সঙ্গে, পরে কংগ্রেসের সঙ্গে। কথাবার্তা হয়েছিল। মুজাফফরাবাদের রাস্তা খুলে গিয়েছিল। এমনকি আমিও মুফতিসাহেবকে শুরুতে বলেছিলাম, বিজেপির সঙ্গে জোট আপনি কীভাবে করতে পারলেন? আমাদের মানুষ একে গ্রহণ করবে না। তিনি বলেছিলেন, শুধুমাত্র রাস্তা আর বাড়ি নির্মাণ করার জন্য আমি মুখ্যমন্ত্রী হতে চাই না। আমার একটা দূরদৃষ্টি আছে। বাজপেয়ীজির সঙ্গে যেটা শুরু হয়েছিল তা মোদিজির সঙ্গে পুনরায় শুরু করতে চেয়েছিলেন আমার বাবা। জীবনের শেষ দিকে এসে এই চ্যালেঞ্জ তিনি গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন। আমাদের মানুষজনের ক্ষোভ ও হতাশা সত্ত্বেও। তিনি ভালরকম জানতেন,যে সিদ্ধান্ত তিনি নিচ্ছেন তা ভীষণ আনপপুলার। কিন্তু তারপরেও তিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কারণ তিনি কাশ্মীর ও ভারতকে একটা সুযোগ দিতে চেয়েছিলেন।
তিনি সবকিছুকে বাজি রেখেছিলেন তাঁর মর্যাদা, তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতা, আমাকে, পিডিপি। আমাদের দলের কর্মীরা বলেছিলেন, মোদির সঙ্গে আমরা কীভাবে চলতে পারি। মুফতিসাহেব বলেছিলেন, আমরাই আর্ত, মোদি নন। বিপুল ভোটে তিনি জয়ী হয়েছিলেন। আমার বাবা প্রতিটা কাশ্মীরির অংশগ্রহণের মাধ্যমে একে অন্তর্ভুক্তিমূলক করে তুলেছিলেন। এতে বিপুল ঝুঁকি ছিল। তাঁর লোকজন খুবই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি হয়। কিন্তু তিনি এটা করতে চেয়েছিলেন। কাশ্মীর ও কাশ্মীরিদের ঐক্যবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন এমন একটি দলের সঙ্গে যারা ভারতে বিপুল ভোটে জয় লাভ করেছে। তিনি বলেছিলেন, অন্য কোনও পথ নেই। তিনি আরও বলেছিলেন, দেখো, আমাদের মর্যাদা রয়েছে, আমাদের নিজস্ব পতাকা রয়েছে, শক্তিশালী বিধানসভা রয়েছে, আমরা কেন কিছুকে ভয় পেতে যাব?
প্রশ্নঃ তিনি মোদির উপর এতখানি বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন?
উত্তরঃ এটা এতটা সরল নয়। হয়তো তিনিও জানতেন যে, এটা দীর্ঘদিন থাকবে না। আসলে, জোটের দুই তিন মাস আগেও তিনি পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলেন না। হাসিব (দ্রাবু) এসে তাঁকে বলেন যে, সব বিষয়ে মোদি বাহিনী রাজি হচ্ছেন না এবং এর ফলে সন্দেহ ঘনিয়েছিল। এই কারণে আমরা জোটের এজেন্ডার খসড়া তৈরি করেছিলাম। সেখানে ৩৭০ ধারায় আমাদের বিশেষ মর্যাদার কথা উল্লেখ করা ছিল। সেই সঙ্গে, আফস্পার প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি, হুরিয়ত ও পাকিস্তানের সঙ্গে কথোপকথন ও উপত্যকায় পণ্ডিতদের ফিরে আসার বিষয়ও ছিল। বলতে গেলে, এটা ছিল আমাদের স্ব-শাসিত নথি। মোদি শেষ পর্যন্ত কী করবেন তা নিয়ে সন্দেহ থাকায় তিনিও দেরি করার চেষ্টা করছিলেন।
জোটের ঠিক আগে গভর্নরের সঙ্গে তাঁর বৈঠকের সময় তিনি তাঁকে বলেন, যখন বিজেপির লোকজন আসবেন তখন তাঁদের বলে দেবেন যেন ‘ভারত মাতা কি জয়’ না বলেন, কারণ আমরা ইতোমধ্যেই ‘হিন্দুস্তান জিন্দাবাদ’ বলছি। এই স্লোগানটাই কেন তাদের চিৎকার করে বলতে হবে? সব সময়ই তাঁর মনে সন্দেহ ছিল। কিন্তু, তারপর তিনি প্রয়াত হলেন এবং কাশ্মীরের জন্য এটা সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক বিষয়।
প্রশ্নঃ বিজেপির সঙ্গে হাঁটার আগে আপনি অনেকটা সময় নিয়েছেন, তিন মাসেরও বেশি?
উত্তরঃ আমার এখনও মনে আছে, রাজনাথজি একই দিনে এসেছিলেন এবং আমাকে বলেন, মেহবুবাজি, তৈরি থাকুন। আমি তাঁকে বললাম, কী জন্য? আমি জোট বাঁধতে চাইনি। আমার বাবাকে মারাত্মক মানসিক চাপের মধ্য দিয়ে যেতে দেখেছি। জোট ও মানুষের আবেগের মধ্যে তিনি আটকে ছিলেন। আজ তারা আমার দিকে ‘সাম্রাজ্য-সাম্রাজ্য’ বলে চিৎকার করেন কিন্তু তারাই আক্ষরিকভাবে আমার কাছে প্রার্থনা করেছিলেন ক্ষমতায় বসার জন্য।
একটা ধারণা ছিল যে, মুফতিসাহেব যেটা শুরু করেছিলেন সেটা আমি মাঝপথে ছেড়ে পালাব না। তারপর অনেক গোষ্ঠী ও ব্যক্তি দলকে হাইজ্যাক করার চেষ্টা করেছিল। আমি মনে মনে ভেবেছিলাম, তারা যদি কিছু ঘটিয়ে ফেলতে সক্ষম হয় এবং জোটের এজেন্ডা ছাড়াই সরকারে বিজেপি-গেম খেলে দেয় তাহলে সব দোষ আমার উপর গিয়ে পড়বে। সেই সময় বাধ্যতা ছিল, আমার কাছে বিকল্প ছিল না।
তরজমাঃ জিয়াউল হক