পুবের কলম, ওয়েবডেস্ক: প্রবাদ আছে ‘বন্যেরা বনে সুন্দর, আর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে’। অর্থাৎ যার যেখানে অবস্থান, তাকে সেখানেই ভালো মানায়। কিন্তু অরণ্য ছেড়ে বন্য পশুরা লোকালয় চলে এসে যদি আক্রমণ চালায়, তখনই ঘটে ভয়ংকর ঘটনা। বন্য পশুদের আক্রমণে মানুষের প্রাণহানি নতুন কিছু নয়। তবে সত্যি এই ধরনের ঘটনা সমাজের কাছে অত্যন্ত মর্মান্তিক ও বেদনাদায়ক।
সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন সামনে এসেছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে কর্নাটকে প্রতি সপ্তাহে গড়ে পশুর আক্রমণে একজন মানুষের মৃত্যু হয়। বন দফতরের তরফ থেকে একটি তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। সেই তথ্য অনুযায়ী ২০১০-১১ থেকে ২০২৩-২৪ মার্চ পর্যন্ত কর্নাটকে মানুষ-বন্যপ্রাণী সংঘর্ষে ৬১৮ জন মানুষের প্রাণহানি হয়েছে।
প্রতি সপ্তাহে গড়ে বন্য প্রাণীর আক্রমণে একজন মানুষের মৃত্যু হয়। এই ধরনের ঘটনার বেশিরভাগ রিপোর্ট পাওয়া গেছে রাজ্যের দক্ষিণাঞ্চলে ব্যানারঘাটা, চামরাজানগর, মাইশোর, কোডাগু এবং হাসান থেকে চিক্কামাগালুরু বেল্ট থেকে। প্রায় ৬০০’র বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে বন্যপ্রাণীর আক্রমণে। এর মধ্যে বেশিরভাগ মৃত্যু হয়েছে হাতির হামলায়। হাতির আক্রমণে মৃত্যু হয়েছে ৪১৬ জনের, চিতা প্রাণ কেড়েছে ৩৮ জনের, ভাল্লুকের হামলায় মারা গেছে ৩৬ জন, বাঘের আক্রমণে মৃত্যু হয়েছে ৩৪ জনের, বাকি ৩২ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে অন্যান্য বন্য পশুর আক্রমণে।
কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়া সরকার এই ঘটনাগুলিকে খুব সাংঘাতিক একটি সমস্যা বলে উল্লেখ করেছেন। ফেব্রুয়ারিতে রাজ্যের বাজেট পেশ করার সময়, সিদ্দারামাইয়া বন্য প্রাণীদের থেকে বন ও ফসলকেরক্ষা সহ স্থানীয়দের প্রাণরক্ষার জন্য একটি রূপরেখা দেন। মানুষ-প্রাণী সংঘাত মোকাবিলায় রেলওয়ে বাজেট বরাদ্দ করা হয়েছিল।
রেলওয়ে ব্যারিকেড নির্মাণের জন্য পূর্ববর্তী বাজেটে (২০২৩-২৪) ১০০ কোটি টাকা প্রদান করা হয়েছিল, প্রায় ৭৮ কিলোমিটার রেলপথ ব্যারিকেড নির্মাণ করা হয়। সরকার জানিয়েছে, চলতি বছরেও (২০২৪-২৫) ব্যারিকেড নির্মাণকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।২০২৪-২৫ সালের জন্য বন বিভাগের বন্যপ্রাণী শাখার জন্য বরাদ্দ করা মোট বাজেট হল প্রায় ১৫১ কোটি টাকা যা বন্যপ্রাণী সম্পর্কিত সমস্ত কাজের জন্য বরাদ্দ।যার মধ্যে ৬০ কোটি টাকা রেলওয়ে ব্যারিকেড নির্মাণের জন্য, যা হাতির হানা থেকে মানুষকে রক্ষা করবে।
বন্যদফতরের কর্মকর্তাদের কথায়, বনের ভিতর প্রচুর আগাছা জন্মাচ্ছে। বিভিন্ন কারণে তারা আবাসস্থল থেকে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। প্রাণীদের সংরক্ষণের প্রচেষ্টায়, বিশেষ করে হাতির জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই বাসস্থান উন্নত করতে হবে। চোরাচালান তুলনামূলকভাবে কমেছে, পশুপাখির সংখ্যা বাড়ছে।তবে যে তৃণভূমি পাওয়া যেত সেগুলিতে এখন ল্যান্টানার মতো আগাছা ছেয়ে যাচ্ছে। ফলে প্রাণীরা বেরিয়ে আসছে।
কর্মকর্তার কথায়, বন্যপ্রাণীদের বাসস্থানযোগ্য করে তোলার জন্য বনের ভিতরের পরিবেশ উন্নত করতে হবে। আগাছা দূর করতে হবে। আর্দ্রতা সংরক্ষণের কাজ করে আমাদের জলের স্তর উন্নত করতে হবে। সর্বোপরি চোরাশিকারি বিরোধী শিবিরগুলিকে আরও সজাগ থাকতে হবে। হঠাৎ আগুন বা দাবানলের হাত থেকে অরণ্যকে বাঁচাতে হবে, তার জন্য প্রয়োজন অর্থের।
আগে করা সমীক্ষার ভিত্তিতে, বিভাগ ইতিমধ্যেই রেলওয়ে ব্যারিকেড নির্মাণের প্রয়োজন এমন জায়গাগুলিকে চিহ্নিত করেছে। প্রাথমিকভাবে, প্রায় ৬৪০ কিলোমিটার চিহ্নিত করা হয়েছিল যেখানে রেল ব্যারিকেডের প্রয়োজন ছিল। এখন প্রয়োজন মোটামুটি ৭৫০ কিলোমিটারে বেড়েছে। এর মধ্যে, ২০১৫ থেকে শুরু করে, ইতিমধ্যে ৩১১ কিলোমিটার কভার করা হয়েছে। বর্তমান বছরের জন্য আমাদের কাজ হল ১২০ কিলোমিটার সম্পূর্ণ করা।
এক ঊর্ধতন বন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সংঘর্ষের অন্যান্য এলাকায় রেলওয়ে ব্যারিকেড নির্মাণ বাড়ানোর দাবিও বাড়বে। পাশাপাশি গ্রামবাসীদের অভিযোগ, হাতির আক্রমণ ঠেকাতে পরিখা খনন খোঁড়া হয়, কিন্তু সেগুলি মাটি ধসের কারণে নষ্ট হয়ে যায়।
মানুষ-প্রাণী সংঘাত নিয়ে এক বর্ষীয়ান বনবিভাগে কর্মকর্তা বলেন, প্রাণীদের জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে তাদের স্থানের সংকুলান আরও বেড়েছে। প্রচুর বনাঞ্চল মানুষের বসবাসের উপযোগী করে তোলার জন্য কৃষি জমি সহ সেচের সুবিধার জন্য খাল নির্মাণ করা হয়েছে। কর্নাটকে আনুমানিক ৬৪০০টি হাতি রয়েছে, এর মধ্যে প্রায় ৩৫০টি হতে পারে বন থেকে বেরিয়ে যায়, বেশিরভাগই ১৮-৩০ বছর বয়সী পুরুষ হাতি। হাতিরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই খাবারের খোঁজে গ্রামের কৃষিজমিতে হানা দিয়ে অর্থকরী ফসল নষ্ট করে। এমন পরিস্থিতিতে মানুষ হাতি তাড়াতে এসে তাদের আক্রমণের মুখে পড়ে। ঘটে প্রাণহানির ঘটনা। বেশিরভাগ মৃত্যুগুলিই দুর্ঘটনাজনিত কারণে। ভোরে বা গভীর রাতে এই ঘটনাগুলি ঘটে। কফি বাগানেও দাঁতালদের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
প্রধান বন সংরক্ষক (বন্যপ্রাণী), সুভাষ কে. মালখেদে বলেন, শুধু হাতি নয়, বাঘ, চিতা এবং ভাল্লুকের আক্রমণের মুখে পড়ে মানুষ।আমাদের ফিল্ড কর্মীরা উদ্বেগে রয়েছে। মানব-প্রাণী সংঘাত মোকাবিলার জন্য অন্যান্য বিভাগের সাহায্যও প্রয়োজন, কারণ এটি হঠাৎ এই অঘটনগুলি ঘটে।তখন আমাদের ফিল্ড কর্মকর্তাদের উপর চাপ বেশি পড়ে। সমস্যাটি সমাধানের জন্য আমাদের জেলা পর্যায়ে অনেক সমন্বয় প্রয়োজন এবং প্রতিটি বিভাগের উচিত একসঙ্গে বন বিভাগকে সাহায্য করা। আমাদের বিভাগ শুধু প্রাণী সংরক্ষণই নয়, মানুষকে প্রাণহানির হাত থেকে রক্ষা করারও চেষ্টা করছে।”