আহমদ হাসানঃ আমেরিকান ও ন্যাটো বাহিনী আফগানিস্তানের জনগণকে তাদের ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়ে কাবুল হয়ে পালিয়েছে। যে বিশৃঙ্খল অবস্থায় তারা কাবুল ছেড়ে পালিয়ে গেছে তা সত্যিই লজ্জাজনক।
২০ বছর সংগ্রাম করে যুদ্ধে বিজয়ী তালিবানদের হাতে এখন একছত্র শাসন ক্ষমতা। রাষ্ট্রসংঘ অবশ্য আহ্বান জানাচ্ছে– আফগানিস্তানের অন্য গ্রুপগুলির সঙ্গে তালিবানরা যেন ক্ষমতা ভাগ করে নেয়। কিন্তু তাতে তালিবানরা রাজি হবে কি না সে বিষয়ে ঘোরতর সন্দেহ রয়েছে। আফগানিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এক হিসেব অনুযায়ী– দু’দশক ব্যাপি এই আফগান যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি হিসেব মতে ৭৭ হাজার ৬০০ কোটি ডলারেরও বেশি অর্থ ব্যয় হয়েছে– এতে নিহত হয়েছে তাদের ২–৩১২ জন সৈন্য– জখম হয়েছে ২০ হাজারের বেশি– আফগান সৈন্য ও পুলিশ নিহত হয়েছে আনুমানিক ৬৪–০০০ আর আফগান বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছে অন্তত ১১–১–০০০। আর আফগানিস্তানের যে সমস্ত মার্কিন সেনা ‘কনট্রাক্টর’ আহত– পঙ্গু ও বিকলাঙ্গ হয়ে দেশে ফিরে গেছেন তাদের চিকিৎসা ও সেবার ব্যবস্থাপনা ভাতা দিতে গিয়ে ওয়াশিংটনের হতশাস অবস্থা। তাই কাবুলের পতনকে এখন অনেকে দেখছেন আফগানিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ প্রয়াসের পরাজয়ের চরম মুহূর্ত এবং খানিকটা মুক্তি হিসেবেও। ঘনাদার কথায়– ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি।’
তালিবানরা কি ধরনের সরকার গড়বে– কি ধরনের সংবিধান গ্রহণ করবে তা এখনও পরিষ্কার নয়। তবে তালিবান নেতৃত্ব স্পষ্ট করে দিয়েছে– তারা কুরআন– সুন্নাহ এবং শারিয়া অনুযায়ী দেশ শাসন করবে। প্রতিষ্ঠিত হবে ইনসাফ। কারও প্রতি কোনও অন্যায় করা হবে না। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের প্রাণ-সম্পত্তি ও ইজ্জত সুরক্ষিত থাকবে। তালিবানরা তাদের ঘোষণায় আরও বলেছেন– নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল সরকারি কর্মচারিরা নির্ভয়ে নিজের কাজে যোগ দিতে পারে।
আমেরিকানরা চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে কাবুল ত্যাগ করলেও এখনও পর্যন্ত তালিবান বাহিনী ও নেতৃত্ব সংযম বজায় রেখেছে। কোথাও গণহত্যা দূরে থাক– রক্তপাতও করেনি। তাদের এই সুশৃঙ্খল রূপ দেখে পশ্চিমা সাংবাদিকরা খানিকটা অবাক হয়েছেন। এখনও পর্যন্ত তালিবানরা সারা আফগানিস্তানে আইন-শৃঙ্খলা বজায় রেখেছে। কোথাও লুঠপাটের কোনও সংবাদ এখনও পাওয়া যায়নি। এই ধরনের অনিশ্চয়তা মূলক পরিস্থিতিতে অন্য দেশে কিন্তু লুঠপাট– খুন-খারাপি চলে। আফগানিস্তানে তা হয়নি। এটা নিশ্চয়ই তালিবানদের খুব বড় কৃতিত্ব।সমগ্র পশ্চিমা মিডিয়া জুড়ে দেখা যাচ্ছে ব্যাপক হাহাকার চলছে। এই হাহাকারের মূল বক্তব্য একটাই– ‘আরে ভাই এবার আফগান নারীদের কি হবে?? তালিবানরা তো তাদের সমস্ত স্বাধীনতা হরণ করবে। তারা তো মানুষ হিসেবেই স্বীকৃতি পাবেই না। তাদের সব স্বাধীনতা– মর্যাদা– হিজাব না পরে ‘সাহসী’ পোশাক পরার সমস্ত ‘স্বাধীনতা তো বিলকুল শেষ হয়ে গেল।’ কেউ কিন্তু বলছে না– আমেরিকা ও পশ্চিমা দেশগুলির ২০ বছরের শাসনে আফগানিস্তানের কি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তাদের মানবিক ও নাগরিক পরিকাঠামো কতটা ধ্বংস হয়েছে। কতজন আফগান শহিদ হয়ে তাঁদের পরিবারগুলিকে নিঃসহায়– ভিখারিতে পরিণত করেছে। কত কারখানা– কত বাড়ি-ঘর– কত হাসপাতাল– কত স্কুল বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপে ধ্বংস হয়েছে। যেন আফগান নারী– পুরুষ ও শিশুর জীবন ও সম্পত্তি ধর্তব্যের মধ্যেই নয়।
কি করে আফগানরা নিজেদের সরকারের অধীনে দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পুনর্গঠন করবে– এইসব বিষয় নিয়ে কারও কোনও বক্তব্য নেই। যুদ্ধে আফগানিস্তানের হাজার হাজার এতিম– বাল-বালিকা ও পঙ্গুদের কিভাবে পুর্নবাসিত করা হবে? এইসব প্রশ্নে সবাই চুপ। তাদের কথা– উচিত শিক্ষা দিয়ে এসেছি আফগানদের। আর কেন আমরা আফগানিস্তান নিয়ে মাথা ঘামাবো। সত্যি কি তাই! বরং প্রথমে ব্রিটেন তারপরে সোভিয়েত রাশিয়া এবং সব শেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও তার সাঙ্গপাঙ্গরা আফগান ভূমিতে চরম পরাজয় বরণ করেছে। তারা তাদের সমরাস্ত্র নিয়ে শেষ পর্যন্ত পাততাড়ি গুটোতে বাধ্য হয়েছে। আফগানদের এই স্বাধীনতার স্পৃহাকে অবশ্যই সালাম জানাতে হয়।
যাই হোক– আফগানিস্তানের অসহায় মানুষদের জন্য নয়– বিকলাঙ্গ শিশুদের জন্য নয়– অসহায় বিধবাদের জন্য নয়– দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হাজার হাজার মানুষের জন্য নয়– পশ্চিমা গণমাধ্যম অনবরত কেঁদে চলেছে আফগান নারীদের দুঃখে। তাদের কি হবে? তারা তো আর ‘বোল্ড’ পোশাক পরতে পারবে না! তারা তো পশ্চিমা নারীদের মতো প্রায় বিকিনি পরে ক্লাবে পারবে না! তারা তো পুরুষ জাতিকে খুশি করার জন্য দেহাবল্লরী সাজিয়ে নিজেদের পেশ করতে পারবে না! তাহলে আফগান নারী স্বাধীনতার কি হবে? ২০ বছর রাজত্ব করেও তো আফগান নারীদের জন্য পশ্চিমাদের এত কর্মকাণ্ড সবই তো বিফলে গেল।
অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র– ফ্রান্স বা জার্মানিতে নারী স্বাধীনতার কি অবস্থা তা মাঝেমধ্যে সমীক্ষায় কিংবা সংবাদে প্রকাশ পায়। সেখানে বেশির ভাগ নারীকে পুরুষদের কাছে পণ্য হিসেবেই বিবেচিত হতে হয়। আর সেভাবেই পশ্চিমা রাষ্ট্রের সমাজ ব্যবস্থাকে গড়ে তোলা হয়েছে।
যাই হোক দ্বিতীয়বার ক্ষমতা পুর্নদখল করে তালিবানরা নারীদের সম্পর্কে কি বলছে সেটা একবার দেখা যেতে পারে। তালিবানরা আহ্বান জানিয়েছে– নারী-পুরুষ সকলেই সরকারি-বেসরকারি সব ক্ষেত্রে নিজেদের কর্মস্থলে ফিরে কাজে যোগ দিন। প্রত্যেকের জীবন ও সম্পত্তি এবং মর্যাদা নিরাপদ থাকবে। আফগানিস্তানের সরকারি টিভিতে প্রথম দিনের পর নারী কর্মীরা ফিরে এসেছেন। নারী সংবাদ পাঠক সংবাদ পড়ছেন। দেখা গেছে তারা হিজাব পরে তালিবান নেতাদেরও স্বাক্ষাতকার গ্রহণ করছেন।
আমরা জানি না– পরে অবস্থা কি দাঁড়াবে? কিন্তু শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত আমরা আফগানিস্তান থেকে এই সংবাদ-চিত্র পেয়েছি। আমাদের বক্তব্য– আমাদের দেশ ভারত-সহ পশ্চিমা ও ধনী আরব রাষ্ট্রগুলির উচিত আফগানিস্তানের পুর্নগঠনে অংশগ্রহণ করা। ‘মানুষ তো মানুষেরই জন্য’ এই নীতি বাক্যকে সব সময় স্মরণ রাখা। তালিবানদের সঙ্গে বাকি রাষ্ট্রগুলিরযোগাযোগ তাদেরকে আরও উদার হতে সাহায্য করবে। ইতিমধ্যেই তুরস্ক– চিন ও রাশিয়া আফগানিস্তানকে উন্নয়ন ও বিকাশের কাজে সহযোগিতা করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। বিদেশী অধিনতা মুক্ত হয়ে এক নতুন আফগানিস্তান পৃথিবীতে মাথা তুলে দাঁড়াক। এই কামনা হয়তো অনেকেই করবেন।