আবদুল ওদুদ: দেশে নাগরিকদের মৌলিক অধিকারকে হরণ করা হচ্ছে। ধর্ম নিয়ে উন্মাদনার চেষ্টা হচ্ছে। দেশে ধর্ম নিরপেক্ষতার উপর আঘাত হানা হচ্ছে। কেন্দ্রে এমন একটি সরকার ক্ষমতায় আছে, যারা এই কাজটি করে যাচ্ছে। কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের নাম না করে এমনই অভিযোগ আনলেন রাজ্য বিধানসভার স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়।
শনিবার কলকাতার নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে এক প্রতিনিধি সম্মেলনে এই বক্তব্য রাখেন স্পিকার। তিনি আরও বলেন, ধর্মীয় বিভেদ তৈরি করা দুর্ভাগ্যের ব্যাপার। যেকোনও মূল্যে আমরা সংবিধানকে রক্ষা করব।
সকলে শান্তি ও সম্প্রীতির মধ্যে বসবাস করেন এ বাংলায়। প্ররোচনা দিয়ে বিভেদ তৈরি করা হচ্ছে। স্পিকার আরও বলেন, ১৯১৯ সালে সংসদে অবৈধভাবে একটি বিল পাশ করা হয়েছে। তার ইঙ্গিত ছিল, সিএএ-এর প্রতি। তিনি বলেন, সম্প্রীতি রক্ষায় নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়াম থেকে জমিয়তে উলামা যে বার্তা দেবে, সমস্ত ভারতবাসীর জন্য সেই বার্তা হবে অত্যন্ত কার্যকরী।
উল্লেখ্য, নেতাজি ইন্ডোর ছিল প্রায় কানায় কানায় পরিপূর্ণ। আর খুবই সুশৃঙ্খলভাবে হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতি সত্ত্বেও এই অনুষ্ঠান সু¨রভাবে শেষ হয়।
জমিয়তের সভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে রাজ্য সংখ্যালঘু কমিশনের চেয়ারম্যান তথা সাবেক সাংসদ আহমদ হাসান ইমরান বলেন, আজকের সভা জমিয়তের প্রতিনিধি সভা হলেও আজ এখানে হিন্দু-মুসলিম সকলে এসেছেন। ফলে এই সভা জাতীয় সভায় পরিণত হয়েছে।
তিনি বলেন, জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ একটি সর্বভারতীয় সংগঠন, দেশের স্বাধীনতায় এই সংগঠনের অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে। ১০৪ বছর ধরে জাতির সেবায় কাজ করে চলেছে। জমিয়ত শুধু সংগঠনই নয়, দেশের নানা দুর্যোগে মানুষের পাশে থেকেছে। বন্যা কিংবা দুর্যোগ অথবা দাঙ্গা-বিধ্বস্ত এলাকায় গিয়ে মানুষের জন্য কাজ করেছে। সব ক্ষেত্রেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।
জনাব ইমরান বলেন, দেশের মানুষকে সম্প্রীতির দিশা দেখিয়েছে এই জমিয়ত। তিনি সিএএ এবং এনআরসি প্রসঙ্গে বলেন, কেন্দ্রের বিজেপি সরকার দেশের নাগরিকদের চাপে রাখার জন্য এই সব ইস্যু খাড়া করছে। মতুয়ারাও নাগরিকত্ব নিয়ে সংকটে রয়েছেন। তিনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশংসা করে বলেন, আমাদের মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, জীবন থাকতে এই বাংলায় এনআরসি ও সিএএ হতে দেবেন না।
তিনি বলেন, আমাদের হাতিয়ার সংবিধান, সম্প্রীতি এবং খিদমতে খ্বাল্ক বা সৃষ্টির সেবা। আর এই সংবিধানকে রক্ষা করার জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একাকিনী লড়ে চলেছেন। অসমে বিজেপি সরকার মাদ্রাসায় তালা ঝুলিয়েছে, সেই প্রসঙ্গটিও তুলে ধরে তিনি বলেন, আমরা কখনও ভাবিনি দেশে এইভাবে সাম্প্রদায়িক শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে বিভেদ তৈরি করবে। হাজার বছর ধরে আমরা একসঙ্গে পথ হাঁটছি।
বর্তমানে অবস্থা এত ভয়াবহ যে, কোনও মুসলিম ড্রাইভার রাস্তার এক ধারে গাড়ি দাঁড় করিয়ে নামায পড়লেও তাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। তারা বিরুদ্ধে নানা ধারায় মিথ্যা মামলা রুজু করা হচ্ছে। আর ধর্মস্থান আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বেশকিছু মসজিদ ভাঙার জন্য তালিকা তৈরি করা হয়েছে।
তাই আমাদের সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রতিহত করতে হবে। আগামী ২২ জানুয়ারি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে সংহতি মিছিলের ডাক দিয়েছেন, সেই মিছিলকে সফল করার জন্য সকলকে হাজির হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
ফুরফুরা শরীফের পীরজাদা ত্বহা সিদ্দিকী বলেন, সংখ্যাগুরুদের আবেগের উপর ভর করে রামমন্দিরের রায় দেওয়া হয়েছে। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে এক শ্রেণির মানুষ সম্প্রীতি বিনষ্ট করতে নানা রকম ঝামেলা তৈরির চেষ্টা করবে, তা থেকে আমাদের বাঁচতে হবে। সাম্প্রদায়িক শক্তি যাতে কোনওভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে সেদিকে আমাদের সজাগ থাকতে হবে।
নবদ্বীপ ধামের মহারাজ যোগী প্রতীক মজুমদার বলেন, সংবিধান আমাদের সকলের অধিকারের কথা বলে, সকলকে সমান অধিকার দিয়েছে। কিন্তু হঠাৎই কেন্দ্রের এক সরকার মানুষের মধ্যে বিভেদ তৈরি করছে। তিনি হযরত মুহাম্মদ সা.-এর প্রসঙ্গ তুলে বলেন, তাঁর মতো প্রশাসক আর কেউ হতে পারে না।
রাজ্য জামাআতে ইসলামের আমীর ডা. মসিউর রহমান বলেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে ফ্যাসিবাদ ক্রমন্বয়ে বাড়ছে। ধর্মভিত্তিক মেরুকরণের খেলা বন্ধ করতে হবে, বাংলায় বিভাজনের রাজনীতি চলবে না। বাংলা দেশকে পথ দেখিয়েছে। বিভাজনের রাজনীতি বন্ধ করতে সিভিল সোসাইটিকে আরও এগিয়ে আসতে হবে।
রাজ্য জমিয়তের সভাপতি মাওলানা সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরি এ দিন ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। তিনি বলেন, ১০০ বছর ধরে জমিয়ত নীরবে নিজেকে দেশ সেবার কাজে নিয়োজিত রেখেছে। দেশের বহু চড়াই-উতরাইয়ের সাক্ষী এই সংগঠন। জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের দৃঢ় ও পবিত্র সূত্র ধরে ভারতবর্ষের মুসলমান সমাজ এই সংগঠনকে ধরে রেখেছে। গোটা দেশে এক কোটি সদস্য রয়েছে।
২৩টি রাজ্যে এই সংগঠন অত্যন্ত মজবুত। তিনি আরও বলেন, সংবিধানে জনগণের মৌলিক অধিকারের রক্ষাকবজ থাকা সত্ত্বেও নাগরিকরা যেন এখন দিশেহারা, দ্বিধাগ্রস্ত। দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। জমিয়তের প্রতিনিধি সম্মেলন চায় সরকার তার দায়িত্ব পালন করুক।
আদালতকে সংবিধান ও আইনের আলোকে স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে দেওয়া হোক। আমরা সংবিধানের মর্যাদাহানি হতে দেব না। সংবিধানকে রক্ষ করতে সর্বপ্রকার বলিদান দিতে প্রস্তুত।
সভায় জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মাওলানা হাকিমুদ্দিন বলেন, ২৬ জানুয়ারি এবং ১৫ অগস্ট প্রতিটি মাদ্রাসায় প্রজাতন্ত্র দিবস এবং স্বাধীনতা দিবস পালন করতে হবে। যুবকদের এ ব্যাপারে আরও এগিয়ে আসতে হবে।
যুব সম্প্রদায় পারে একটি জাতিকে পথ দেখাতে। তাই যুবসমাজকে আরও অগ্রণী হতে হবে। প্রতিটি শিশু যাতে আগামী দিনে দ্বীনের তালিম নিয়ে ঈমানের সঙ্গে বড় হয় সে-ব্যাপারে আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে।
অধ্যাপক মাওলানা মনজুর আলম বলেন, আমরা সংবিধানকে নিয়ে বেঁচে রয়েছি। আগামী দিনেও এই সংবিধানকে নিয়েই বাঁচব, আমরা বিভেদ পছন্দ করি না। সকলকে নিয়ে চলতে চাই। আগামী দিনেও চলব।
এ দিনের সম্মেলনে আরও বক্তব্য রখেন আইনজীবী প্রসূন কুমার দত্ত, মুফতি ইমদাদুল ইসলাম, মাওলানা তাহেরুল হক, মোকতার আলি, মাওলানা জাকি মাদানি, মাওলানা আবদুস সামাদ, হাফেজ নজরুল ইসলাম, আনিসুর রহমান, হাফেজ সাইদুল ইসলাম প্রমুখ।
এ দিন অনুষ্ঠানে দফ-এর বাজনার সঙ্গে আরবি নাত পাঠ করেন ছোট্ট তিন শিশু শিল্পী ইয়াহিয়া, জিন্নাতুন এবং ফৈয়াজ আহমেদ। তার পরিবেশিত এই নাত উপস্থিত হাজার হাজার মানুষের মন ছুঁয়ে যায়। এ দিন প্রজেক্টরের মাধ্যমে জমিয়তের কার্যকলাপ তুলে ধরা হয়। সমগ্র অনুষ্ঠানটি সার্বিকভাবে সফল করতে অন্যান্যদের সঙ্গে বড় ভূমিকা রাখেন রাজ্য জমিয়তের সাধারণ সম্পাদক মুফতি আবদুস সালাম।