জৈদুল সেখ: বামপন্থী বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় আমার ছোট্ট বেলা থেকেই টান। লেখালেখিও বটে। নতুন একটা পত্রিকা পাতা উল্টোতেই চোখে পড়ল ‘ভারতবর্ষ’ নামক গল্প, দেরি না করে কিনে নিলাম। বহরমপুর থেকে জীবন্তি বাসে সিট পাওয়া মানে সৌভাগ্য। তবে সেদিন পেয়েছিলাম সিটে বসেই পড়তে লাগলাম ‘ভারতবর্ষ’! পড়তে পড়তে চিত্র ফুটে উঠছে আমি যে রাস্তায় যাচ্ছি জীবন্তি গোকর্ণ কান্দির বিস্তৃর্ণ অঞ্চলের। কিন্তু প্রথমে বিশ্বাস হচ্ছিল না! পরে লেখক লেখকের নাম ভালো করে পড়লাম সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ। হ্যাঁ লেখকের নামে আগে দু একটা গল্প পড়া ছিল কিন্তু এই গল্পে আমাদের অঞ্চলের চিত্র ভাবা যায়!
সিরাজ কে! কোথায় বাড়ি! এই সব তখন কিছুই জানতাম না। কেবলমাত্র ভারতবর্ষ গল্প পড়ে সিরাজ সাহেবের সম্পর্কে জানার অদম্য ইচ্ছা বেড়েই চলেছে। অথচ এ যেন লালল ফকিরের সেই বিখ্যাত বার্তা
‘আমার বাড়ির কাছে আরশিনগর
ও এক পড়শি বসত করে।’
আবার সে আর লালন একখানে রয়
তবু লক্ষ যেজন ফাঁক রে।’
গ্রামের মাষ্টার নামে পরিচিত মান্নান মাষ্টার এবং প্রফুল্ল চন্দ্র করের সঙ্গে আলোচনায় জানতে পারলাম। মান্নান সাহেব বললেন, আরে তুই জানিস না আমরা একসঙ্গে আলকাপ করে বেড়াতাম রে, এক সময়ে এই জীবন্তিতেই ছিল তার ভাত বাড়ি, মানুষ হিসাবে খুব ভালো।
প্রথম দিকে আমরা সিরাজ সাহেব কে খুব একটা পাত্তা না দিলেও সে অনেক পরিশ্রম করে দল করেছিল, জীবন্তি, মহলন্দী, উদয়চাঁপুর সহ বিভিন্ন এলাকায় তার আড্ডা ছিল। পরবর্তীতে অনেক নামও কামিয়েছে।
যাইহোক শুনেছি সে এখন কলকাতায় গিয়ে অনেক বড়ো সাহিত্যিক হয়েছে আমরাও পেপারে মাঝে মধ্যে ওর লেখা পড়ি কিন্তু জানিস প্রফুল্ল আর আমার ভালো বন্ধুগত বই মেলায় আমাদের জীবন্তি যুগদূত ক্লাবে আসার কথা ছিল কিন্তু টেলিফোন করে জানতে পারলাম সে অসুস্থ। তুই লেখালেখি করছিস টেলিফোন নম্বর নে যোগাযোগ করবি আমাদের বন্ধু এখন অনেক বড়ো সাহিত্যিক!
তারপর সিরাজ সাহেবের কথা বার বার ভাবতে লাগলাম, তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করার অক্লান্ত ইচ্ছা জাগলো। আনন্দিত হলাম। একদিন সকালে ফোন করলাম, দু তিনবার পর ফোন তুললেন। বললাম, সিরাজ সাহেব বলছেন! উত্তর এল এক মহিলার, না। তিনি খুব অসুস্থ! পরে ফোন করবেন।
সিরাজ সাহেবের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি! যা আজও না পাওয়ার বেদেনা হয়ে রয়ে গেছে। যদিও বেশ কিছুদিন পর একেবারে গোকর্ণ খোসবাস পুর গ্রামে তাঁর শেষ যাত্রার সঙ্গী হিসাব চোখের জলে বিদায় জানাতে পেরেছিলাম। চোখের জলে শেষ বিদায়ে প্রথম পরিচয়।
এ যেন আকাশে বাতাসে মর্মরিত ধ্বনি
পাখিরা যারা হাজার বছর ধরে খেলছিল
তাদেরও চোখে অজস্র অশ্রু!
কেবল চির নিদ্রায় নিদ্রায় অলীক মানুষ’
সে বছর জীবনের প্রথম কাঁচা হাতে দায়িত্বে নিয়ে একটি নজরুল সংখ্যা পত্রিকা বের করার কাজ চলছিল। বড়ো বাসনা ছিল সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ সাহেবের একটা লেখা পাওয়া। কিন্তু হয়নি ঠিকই কিন্তু বড় পাওনা পেয়ে গেলাম যখন দ্বাদশ শ্রেণির বাংলা পাঠ্যপুস্তকে স্থানে পেল অলীক মানুষের ‘ভারতবর্ষ’ গল্পটি। আজও সে যে কী আনন্দ। অনেক কিছু না পাওয়ার বেদনা ‘ভারতবর্ষ’ সিলেবাসে স্থান পাওয়ায় পেয়েছি যা হিজল কণ্যা যানে আর জানে অন্তর্যামী।