আহমদ হাসানঃ সাগরদিঘি উপনির্বাচনে বাম-কংগ্রেস এক হয়ে পরাজিত করেছে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থীকে। জিতেছে কংগ্রেস প্রার্থী। কিন্তু সব থেকে উজ্জীবিত হয়েছে সিপিএম। তারা বুঝেছে,যদি পশ্চিমবাংলার অস্তিত্ব ফিরিয়ে আনতে হয়, তাহলে সংখ্যালঘু ভোট ছাড়া গত্যন্তর নেই।
সিপিএম-এর কৃষক, শ্রমিক প্রভৃতি যে ভোটব্যাঙ্ক ছিল,তা এখন অনেকটাই নেই। মুখে মার্কসবাদ, লেলিনবাদের কথা বললেও যে তারা কমরেডদের ঠিকমতো তালিম-তরবিয়ত করতে পারেনি, তা বোঝা যায় যখন দলে দলে বাম সমর্থক ও নেতারা বিজেপিতে চলে যায়। ‘বাম ছেড়ে রাম’ একটি নয়া প্রবাদ বাক্যে পরিণত হয়।
এই দুরবস্থায় কিন্তু একটা জিনিস লক্ষণীয়, পশ্চিমবাংলায় বিজেপির তুলনায় সিপিএম-এর সাংগঠনিক পরিধি অনেক বেশি জোরদার। একই কথা প্রযোজ্য, কংগ্রেস সম্পর্কেও। তাদের কিছু ট্র্যাডিশনাল সমর্থক অবশ্যই রয়েছে, বিশেষ করে মুর্শিদাবাদ, মালদা, দিনাজপুর প্রভৃতি এলাকায়। কিন্তু তেমন কোনও নেতৃত্ব নেই যারা সমর্থনকে সংগঠিত করবে।
সিপিএম এবার বুঝতে পেরেছে যে, এবার তাদেরকে ফের মুসলিমদেরই শরণাপন্ন হতে হবে। আর সেই লক্ষ্যেই তারা কাজ শুরু করেছে।
মুহাম্মদ সেলিমকে পশ্চিমবাংলায় দলের প্রধান করা হয়েছে। সেক্ষেত্রেও হয়তো কমরেড নেতৃত্বের হিসেব ছিল, সেলিমকে নেতৃত্বে আসীন করলে সিপিএম যে মুসলিমদের থেকে যোজন দূরে সে অপবাদ হয়তো খানিকটা হলেও লাঘব হতে পারে।
সম্প্রতি সিপিএম মুসলিমদের সামনে রেখে দুদিন ব্যাপী একটি বড় অনুষ্ঠান করেছে। অবশ্য দল নিজে এ কাজে সামনে আসেনি, সামনে ছিল ‘হাসিম আবদুল হালিম ফাউন্ডেশন’।
সিপিএম-এর বামপন্থীরাই এই ফাউন্ডেশনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন। গণশক্তিতে প্রকাশিত বিজ্ঞাপনে দেখা যাচ্ছে, ১১ ও ১২ মার্চ দু’দিন ব্যাপী জাতীয় সেমিনারে আলোচ্য ছিল, ‘সাচার কমিটি এবং মুসলমান প্রশ্নn সমসাময়িক ভারত এবং পশ্চিমবঙ্গ।
প্রথমদিনে এক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয় আশুতোষ জন্মশত বার্ষিকী হলে। অনলাইনে সেমিনারটির উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট মুসলিম নেতা এবং কেন্দ্রের সংখ্যালঘু বিষয়ক প্রাক্তন মন্ত্রী ও রাজসভার সাবেক ডেপুটি চেয়ারপার্সন কে রহমান খান।
প্রধান অতিথি ছিলেন প্রাক্তন লেখক জেনারেল জমিরউদ্দীন শাহ। তিনি আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়েরও উপাচার্য ছিলেন।
এ ছাড়া ন্যাশনাল মোমিন কনফারেন্সের প্রেসিডেন্ট শাকিলুজ্জামান আনসারি, যিনি অনগ্রসর মুসলিমদের মধ্যে কাজ করেন ছিলেন তিনিও। বিশেষ অতিথি ছিলেন মুহাম্মদ সেলিম। আর অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন হাসিম আবদুল হালিমের পুত্রবধূ সায়রা শাহ হালিম যিনি বালিগঞ্জে সিপিএম-এর প্রার্থী ছিলেন। এ ছাড়া আলোচনা হয় সাচার রিপোর্ট ও তার পরিনাম নিয়ে।
পরেরদিন ভাষা পরিষদে অনুষ্ঠিত হয় ‘বিজনেস সেশন’। অন্যতম বক্তা ছিলেন সাবির আহমেদ। বক্তাদের তালিকায় ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি তৌফিকউদ্দীন অবসরপ্রাপ্ত রিটায়ার্ড আইপিএস নজরুল ইসলাম, খোয়াজা জাভেদ ইউসুফ, কুমার রানা, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. জাদ মেহমুদ, প্রফেসর আবদুল মতিন। শেষে বক্তব্য রাখেন সাংসদ আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য।
গণশক্তি ১২ মার্চ যে রিপোর্ট করেছে তার শিরোনাম হচ্ছে ‘বদলেছে আবহ, চর্চাই বন্ধ সাচার কমিটি নিয়ে। ১৩ মার্চ এই সেমিনারের রিপোর্টের শিরোনাম হল ‘রাজ্যে সংখ্যালঘুদের বঞ্চনা উঠে এলো আলোচনা সভায়’। ত্রিপুরার ‘দেশের কথা’ পত্রিকার রিপোর্টের শিরোনাম হচ্ছে ‘সাচার কমিটির রিপোর্ট নিয়ে আলোচনায় উদ্বিগ্ন জিজ্ঞাসা, মুসলিম জনগণের অর্জিত অধিকার রক্ষা করা যাচ্ছে কি?
এর বিস্তারিত বিবরণী নিয়ে পরে আলোচনা করা যাবে। কিন্তু একসময় যে সিপিএম মুসলিম শব্দটি উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে সাম্প্রদায়িক কথাবার্তা বললেন না বলে শ্লোগান দিত, তারাই এখন হঠাৎ করে মুসলিমদের অধিকার, মুসলিমদের বঞ্চনা ইত্যাদি নিয়ে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। বিশিষ্ট মুসলিম ব্যক্তিত্বদের নিয়ে আলোচনাসভার আয়োজন করছে সরাসরি না হলেও তাদের সমর্থিত এনজিও-র মাধ্যমে।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সিপিএম এখন মুসলিম ভোটের জন্য ঝাঁপাতে চাইছে। পশ্চিমবাংলায় সাড়ে তিন কোটি মুসলিম রয়েছে। এর ৯৫ শতাংশ বাংলাভাষী মুসলিম। সিপিএম নেতৃবৃন্দ
ধারণা, মুসলিমরা ৩৪ বছরের বঞ্চনার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের ত্যাগ করলেও এখন তাদেরকে আবার কোলে টানার চেষ্টা করা যেতে পারে। আর তারা স্বীকার করছেন, মুসলিমদের অব্যাহত ভোট সমর্থনেই বামেদের ৩৪ বছর শাসন পাকাপোক্ত ছিল। আর তারা গণহারে তৃণমূল কংগ্রেসকে ভোট দেওয়াতেই বিগত দুটি বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস ব্যাপকভাবে জিতেছে। মুসলিমদের এই ভোট সমর্থনে ভাগ বসাতে না পারলে তৃণমূলকে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করেও হারানো প্রায় অসম্ভব।
সিপিএম, কংগ্রেস এখন আঁচ করতে পেরেছে, ১০ বছরের শাসনের পর হয়তো বা মুসলিমদের মধ্যে তৃণমূল সম্পর্কে কিছুটা ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে বিভিন্ন স্তরে দলীয় পদে মুসলিমদের অনুপস্থিতি যা সংখ্যানুপাতে অনেক মুসলিমদের কাছেই দৃষ্টিকটু লাগছে, তা অনেক ক্ষেত্রে প্রকাশও পাচ্ছে। এসব নানা কারণে সিপিএম এখন নতুন করে মুসলিম ভোটকে নিশানা করেছে।
সবথেকে মজার কথা, যে সাচার কমিটির রিপোর্ট দেখিয়ে দিয়েছিল পশ্চিমবাংলায় বামফ্রন্টের ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শাসনে রাজ্যের মুসলিমরা সবথেকে বেশি বঞ্চিত ও পশ্চাৎপদ আর যে সাচার রিপোর্ট সিপিএম-এর মুসলিম ভোটবাক্সে ধস নামার অন্যতম কারণ, সিপিএম এখন সেই সাচার কমিটিকেই হাতিয়ার করছে। তাদের সেমিনার ও আলোচনাসভার মুখ্য বিষয় ছিল, সাচার কমিটির রিপোর্ট এবং মূলত পশ্চিমবাংলায় শিক্ষা, আবাসন, চাকরি, ব্যাঙ্ক লোন, এলাকা উন্নয়ন ও রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে বর্তমানে তার প্রভাব। অর্থাৎ এই সাচার কমিটিকেই অন্যতম অস্ত্র করে সিপিএম এখন মুসলিমদের কাছে পৌঁছতে চাইছে।