পুবের কলম ওয়েবডেস্ক সাংবাদিক ওয়াংখেম এবং রাজনৈতিক কর্মী লিকমব্যামকে মণিপুর পুলিশ গ্রেফতার করেছিল রাজ্যের বিজেপি নেতাদের অভিযোগের ভিত্তিতে। তারা রাজ্যের বিজেপি নেতা টিকেন্দ্র সিংয়ের কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মৃতু্যর পর ফেসবুকে একটা পোস্ট করেছিলেন ‘গোবর এবং গোমূত্র করোনা সারায় না।’ তাদের গ্রেফতার করা হয়েছিল এই ফেসবুক পোস্ট করার ‘অপরাধে’। ইম্ফলের জেলাশাসক কিরন কুমার গত ১৭ মে এনএসএ আইনে এই দু’জনকে গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছিলেন– কারণ তাঁর মতে উক্ত ফেসবুক পোস্ট ‘শান্তি-শৃঙ্খলা ভঙ্গ’ করতে পারে। ৪০ দিন ধরে দু’জনই ইম্ফলের সাজিওয়া জেলে বন্দি হয়ে আছেন বিনা বিচারে।
জেলাশাসক এবং রাজ্য সরকারের কাছে তাদের মুক্তির আবেদন নাকচ করে দেওয়া হয়েছে। তাদের পরিবার এবার তাদের মুক্তির জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছেন। সেই আবেদনও নাকচ হয়ে গেলে তারা বিচারের জন্য দ্বারস্থ হবেন মণিপুর হাইকোর্টে। মণিপুর সরকার জানিয়েছে– এই মামলায় তাদের কিছুই করণীয় নেই। মণিপুরের পাবলিক রিলেশন মন্ত্রী বিশ্বজিৎ সিং বলেছেন– জেলা আধিকারিকরা দু’জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছেন যখন তখন নিশ্চই তাদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। সরকার গোটা ঘটনা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। এই মামলার ফাইল এখন মুখ্যমন্ত্রীর কাছে রয়েছে। সাংবাদিক ওয়াংখেম এবং রাজনৈতিক কর্মী লিকমব্যামকে কেন গ্রেফতার করা হয়েছে এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি জেলাশক কিরন কুমারের কাছ থেকে।
মণিপুরে এই দু’জনের গ্রেফতারি আসলে এক গভীর রোগের লক্ষণ। এটি রাজ্যজুড়ে মত প্রকাশের স্বাধীনতার উপর সরকারের আঘাত। একটি রিপোর্টে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী– মণিপুর সরকার দেশদ্রোহের ১৩টি মামলা দায়ের করেছে। ইউএপিএ আইনে ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে মণিপুরে ১৭৮৬টি মামলা দায়ের হয়েছে যা দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ। সবই করা হচ্ছে মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংয়ের মর্জি এবং নির্দেশ অনুসারে বলে মন্তব্য করেছেন ইম্ফলের মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যালার্টের ডিরেক্টর বাবলু লয়টংবাম। মত প্রকাশেরর স্বাধীনতার অধিকার এইভাবেই খর্ব করা হচ্ছে মণিপুরে। মুষ্টিমেয় লোক রয়েছেন যারা এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস রাখেন। তিনি বলেন– আর্ন্তজাতিক সংস্থা ওপেন টেকনোলিজি ফান্ড দাবি করেছে– মণিপুরী সাংবাদিকরা সবসময় ক্ষমতাবান লোকেদের কাছ থেকে হুমকি পেয়ে থাকেন। এখানে প্রেস সেন্সরশিপ চলছে। ওয়াংখেম এবং লিকমব্যাম এই রাজ্যে বিজেপির সবচেয়ে বড় সমালোচক। তাদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা ঝুলছে।
২০১৮ সালে প্রথমবার ওয়াংখেমের বিরুদ্ধে এনএসএ আইন প্রয়োগ করা হয়েছিল। তখন রাজ্যে স্বাধীনতা সংগ্রামে রানি লক্ষীবাঈয়ের জন্মদিবস পালিত হচ্ছিল। এই নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন তিনি। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল– একটি ফেসবুক পোস্টে তিনি নরেন্দ্র মোদি এবং মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিংকে অপমান করেছিলেন। ওয়াংখেম ফ্রন্টিয়ার মণিপুরের একজন সাংবাদিক যিনি ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের সমালোচনা করার জন্য পরিচিত। এই সাংবাদিকের বোন রঞ্জিতা জানিয়েছেন– তিনি তাঁর ভাইয়ের পক্ষে মানুষের সমর্থন আশা করছেন। কিন্তু রাজ্যে একটা ভীতির পরিবেশ আছে যেখানে মানুষ মুখ খুলতে ভয় পান।
ওয়াংখেম এবং লিকমব্যামের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়েছিলেন রাজ্যের বিজেপির সাধারণ সম্পাদক মেইটি প্রেমানন্দ। লিকমব্যাম তাঁর বোনের চাপে নিজের ফেসবুক পোস্ট সরিয়ে নিতে সম্মত হয়েছিলেন। কিন্তু তবুও তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তাঁর বোন অনুপমা খেদোক্তি করেছেন যে– আমি জানতাম আমার ভাইকে গ্রেফতার করা হবে। তাদের দু’জনের আইনজীবী ভিক্টর চোংথাম বলেছেন– আদালত তাঁর দু’জন মক্কেলকে প্রথমে ৪ দিনের পুলিশি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছিল। অথচ সুপ্রিম কোর্টের পরিস্কার নির্দেশ আছে যে কোনও অপরাধে যদি ৭ বছরের শাস্তির বিধান থাকে তাহলে অতিমারির প্রেক্ষিতে সেই অভিযুক্তদের জামিন দিতে হবে। গত ১৭ মে পশ্চিম ইম্ফলের জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এই দু’জনকে জামিনে মুক্তি দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু জামিনের রায়ের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তাঁর মক্কেলদের বিরুদ্ধে এনএসএ আইন প্রয়োগ করা হয়। পুলিশ তাঁর মক্কেলদের এবার এনএসএ আইনে গ্রেফতার করে। তাদের যখন দ্বিতীয়বারের জন্য গ্রেফতার করা হয় তখন পুলিশের কাছে গ্রেফতারির নির্দেশ ছিল না। পরে ১৯ মে সেই নির্দেশ জমা করা হয় বলে জানিয়েছেন আইনজীবী ভিক্টর চোংথাম। জেলাশাসকের নির্দেশনামা অনুযায়ী– এই দু’জন নাকি ‘কট্টর অপরাধী’ যাঁরা ধর্মীয় উত্তেজনা ছড়ানোর কাজ করছিল। এরপর জেলাশাসক এবং রাজ্য স্বরাষ্টÉ দফতরের কাছে মুক্তির আবেদন জানালেও কোনও লাভ হয়নি। এরপর আবেদন করা হয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে। যদি সেই আবেদনও খারিজ হয় তাহলে মণিপুর হাইকোর্টের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া আর কোনও পথ নেই। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের মুখপাত্র নীতীন ওয়াকালকার জানিয়েছেন– এই মামলায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের তরফে আপাতত কোনও খবর নেই।