আহমদ হাসান ইমরান: হামাস এবং দুনিয়ার অন্যতম সেরা অস্ত্রশক্তিতে বলিয়ান ইসরাইলের মধ্যে নাকি ‘যুদ্ধ’ হচ্ছে। পশ্চিমা মিডিয়ার এটা হচ্ছে বক্তব্য। আমাদের দেশের টেলিভিশন চ্যানেল এবং বেশিরভাগ পত্রপত্রিকাও পাশ্চাত্যের পোঁ ধরেছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা করেছেন যে, তিনি এই সংকটে ইসরাইলের পাশে আছেন। শুধু একবার নয়, বিবৃতি দেওয়ার পরও ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু-র সঙ্গে কথা বলেছেন। অবশ্য ভারতের না হোক (গান্ধি, জওহরলাল ও বাজপেয়ীর ফিলিস্তিনির প্রতি সাপোর্ট এবং জায়নবাদী ইসরাইলের অবৈধ কার্যক্রমের বিরোধিতার কথা এ প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে) কিন্তু মোদি ও বর্তমান বিজেপির ইসরাইলের প্রতি সমর্থনের কারণ কারও বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। সচেতন পাঠকের কাছে মোদিজী ও ইসরাইলের নীতির মিল কোথায় তা কিন্তু স্পষ্ট। মোদিজীর বিদেশ নীতি কতটা ইনসাফ, ন্যায় বিচারের পক্ষে এবং কতটা বিদ্বেষ ও ঘৃনাবাজির সমর্থনে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে।
সোমবার রাতে ছত্তিশগড় বিধানসভা নির্বাচনে ৬৪ জন বিজেপি প্রার্থীর তালিকা প্রকাশ হয়েছে। ‘সব কা সাথ, সব কা বিকাশ’ করনেওয়ালা মোদিজীর ওই তালিকায় একজনও মুসলিম বা খ্রিস্টানের নাম নেই। বোঝা যায়, মুসলিম, খ্রিস্টান ইত্তকার সংখ্যালঘুদের প্রতি মোদিজীর কত প্রেম, কত ভালোবাসা! ইসরাইলের প্রতি সমর্থনেও মোদিজীর সেই বোধই কাজ করছে বলে অনেকের ধারণা। মোদিজী কিভাবে ভারতের যুগ যুগ ধরে লালিত বিদেশ-নীতিকে পাল্টে ফেললেন তা পুবের কলম পত্রিকাতেও প্রকাশিত হয়েছে এবং হচ্ছে। অথচ হিসেব করলে দেখা যাবে ইসরাইলের তুলনায় মুসলিম দেশগুলির মধ্যেই ভারতের বেশি স্বার্থ নিহিত রয়েছে। একথা অবশ্য ঠিক, মুসলিম দেশগুলির স্বৈরাচারী শাসকরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপ এবং নিজেদের গদি বাঁচানোর স্বার্থে ইসরাইলের সঙ্গে খানিকটা দহরম-মহরম শুরু করতে আগ্রহী। এ বিষয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সউদির যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমান এবং সংযুক্ত আরব আমীর শাহীর প্রধান আমীর মুহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান। কিন্তু মনে রাখতে হবে শাসকরা নয়, আসলে প্রধান বিবেচ্য হল ওই দেশগুলির জনগণ। মরক্কো, কুয়েত, তিউনেশিয়া, আলজারিয়া, ইয়েমেন, ইরান, তুরস্ক, কাতার এছাড়া ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও ইসরাইলি বর্বরতার বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জনগণ পথে নেমে এসেছে। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশ প্রভৃতি রাষ্ট্রেও বিক্ষোভ দেখা যাচ্ছে।
শেষ পর্যন্ত মুহাম্মদ বিন সালমানকে বিবৃতি দিতে হয়েছে, সউদি আরব বরাবরই ফিলিস্তিনের নির্যাতিত জনগণের পক্ষে রয়েছে। কারণ, স্বৈরাচারী শাসক মুহাম্মদ বিন সালমান বুঝতে পেরেছেন, এভাবে গাজায় ফিলিস্তিনিদের নির্মম হত্যাযজ্ঞ মেনে নিলে কঠোর শাসন সত্ত্বেও তাঁর গদি চলে যেতে পারে। সেই সময় বন্ধু ইসরাইলের মোসাদ বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিআইএ তাঁকে রক্ষা করতে পারবে না। যেমনটি ইরানের শাহকে যুক্তরাষ্ট্র রক্ষা করতে পারেনি।
কথা হচ্ছে, অনেকেই জানেন না কিভাবে ব্রিটেন, ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সর্বাত্মক মদদ দিয়ে ইহুদি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলিকে ব্যাপক সহিংসতার জন্য অস্ত্রশস্ত্র যোগান-সহ অবাধ ছাড় দিয়ে রেখেছিলেন। ফিলিস্তিনের ভূমি থেকে শত শত বছরের বাসিন্দা মুসলিমদের উৎখাত করে উদ্বাস্তু বানানো হয় এবং তাদের জন্য কোনও ধরনের পুর্নবাসনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়নি।
পেরিয়ে গেছে প্রায় ৭৫ বছরেরও বেশি সময়। গাজা ও পশ্চিম তীরে খুব সংকীর্ণ স্থানে এই ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুদের প্রাথমিক সুযোগ-সুবিধা ছাড়াই রেখে দেওয়া হয়েছে। আর গাজাকে তো চারিদিকে দেওয়াল দিয়ে ঘিরে ইসরাইল একটি অবরুদ্ধ জনপদে পরিণত করেছে। এই জিনিস যদি অন্য কোথাও করা হয়, তাহলে কি সেখানকার ভুক্তভোগীরা তা মেনে নেবে? কিন্তু এক্ষেত্রে বলা হয়, ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করে সেখানে বিভিন্ন দেশ থেকে ইহুদিদের এনে বসানো হবে এবং ইসরাইল নামে একটি নতুন রাষ্ট্র সৃষ্টি করা হবে, তাতে নাকি রাষ্ট্রসংঘের ম্যানডেট রয়েছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, কোনও দেশের লক্ষ লক্ষ জনগণের উপর রাষ্ট্রসংঘ কি করে এই বর্বর ম্যানডেট চাপিয়ে দিতে পারে? উত্তর হল, হ্যাঁ পারে। আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স এই শক্তিধর রাষ্ট্রগুলি চাইলে সমস্ত ধরনের অন্যায় সম্ভব। ইসরাইল সৃষ্টির পিছনে অবশ্য ভূ-রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামারিক বিবেচনাও রয়েছে। সে বিষয়ে পরে আলোচনা করা যাবে। তবে জো বাইডেন, নরেন্দ্র মোদিজীরা সমর্থন করলেও ফিলিস্তিন সমস্যাকে আর এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। হামাসের মুজাহিদরা যেভাবে ইসরাইলের কথিত নিশ্ছিদ্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ভেঙে খানখান করে দিয়েছে, তা এ কথার প্রমাণবহ। হামাস জানত, এই অসম যুদ্ধে তারা হারবে। কিন্তু ইসরাইলি নির্যাতনের মুখে প্রতিদিন তিলে তিলে মৃত্যুবরণ করার চেয়ে তারা লড়াই করে জীবন বিসর্জন দেওয়াতেই বেহতর মনে করেছে। আর ইসরাইলও এই সুযোগে গাজার বেসামরিক নিরস্ত্র শিশু, বৃদ্ধ, মহিলাদের পশ্চিমা সমর্থনে হত্যা করে চলেছে।