পুবের কলম প্রতিবেদক: দেশের এখন খুব দুঃসময় যাচ্ছে। স্বাধীনতার সংগ্রামীরা যে স্বপ্ন দেখেছিলেন আর আজকের দিনের যে পরিস্থিতি, তার মধ্যে বিস্তর ফারাক। হরিয়ানা নুহ্-এর সংখ্যালঘু মুসলিমরা পাকিস্তানে থাকতে পারতেন, কিন্তু গান্ধিজীর আশ্বাসে তারা সেখানে যাননি। থেকে গিয়েছিলেন ভারতে।
অন্যদিকে একসময় মেইতি ও কুকী জনজাতির লোকজন নেতাজির সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। আর আজ হিংসার আগুনে পুড়ছে মণিপুর। এটা দেখতে চাননি নেতাজি। তবে এই পরিস্থিতি চিরদিন থাকবে না। সাধারণ মানুষের সম্মিলিত প্রয়াসে এই ভেদ-রেখা দূর হবে। বৃহস্পতিবার বিকালে নেতাজি সুভাষচন্দ্রের সাম্য ও ঐক্যের আদর্শ’ শীর্ষক এক বিশেষ বক্তৃতায় এভাবেই নিজের বক্তব্য পেশ করেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও প্রাক্তন সাংসদ অধ্যাপক সুগত বসু।
এ দিন দ্বীনিয়াত মুয়াল্লিমা কলেজ (ডিএমসি) এবং নো ইউর নেবার-এর যৌথ উদ্যোগে আলিপুরের ধনধান্য অডিটোরিয়ামে ছিল বিশেষ আলোচনাসভা ও কলেজ ছাত্রীদের সমাবর্তন অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানের প্রথম পর্বে ডিএমসি’র উত্তীর্ণ ছাত্রীদের সার্টিফিকেট এবং পুরস্কার প্রদান করা হয়।
সেই পর্বে উপস্থিত ছিলেন কলেজের সম্পাদক হায়দার আলী, সভাপতি মাসাউদ রহমান, ক্বারী ফজলুর রহমান, নাখোদা মসজিদের ইমাম শফিক কাসেমী, মাওলানা ইসহাক মাদানী, বেলুড় মঠের সন্দীপন মহারাজ, মুহাম্মদ শাহ আলম, শাহাবুদ্দিন সরদার, ক্বারী মফিদুল ইসলাম প্রমুখ। অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে নেতাজি সুভাষচন্দ্রের সাম্য ও ঐক্যের আদর্শ নিয়ে বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক সুগত বসু। এছাড়াও বিশেষ অতিথি হিসেবে ছিলেন রাজ্য সংখ্যালঘু কমিশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক সাংসদ আহমদ হাসান ইমরান, প্রতীচী ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর মানবী মজুমদার ও ড. জয়ন্ত সেনগুপ্ত।
এ দিনের আলোচনায় অধ্যাপক সুগত বসু নেতাজী সুভাষচন্দ্রের স্বাধীনতা সংগ্রামের নানান ইতিহাস তুলে ধরেন। তিনি বলেন, দেশে বিভিন্ন জনজাতি এবং ভাষাভাষীর মানুষ বসবাস করেন। তাদের মধ্যে সার্বিক ঐক্যের মাধ্যমে ব্রিটিশদের গোলামী মুক্ত হওয়া ও সমুন্নত উন্নয়ন সম্ভব বলে মনে করতেন নেতাজি। নেতাজির মনে এই সাম্য ও ঐক্যের আদর্শের বীজ বপন করেছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস।
নেতাজি কলকাতা মিউনিশিপ্যাল কর্পোরেশনের সিইও হওয়ার সময় নিয়োগে সংখ্যালঘুদের জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন, সে কথাও আলোচনায় উঠে আসে। বেঙ্গল-প্র্যাক্ট থেকে শুরু করে নেতাজির মহানিষ্ক্রমণ, সাবমেরিমন যাত্রা থেকে দিল্লি চলো অভিযান, বিভিন্ন কাজে নেতাজির ছায়াসঙ্গীদের নানান ইতিহাস তুলে ধরেন সুগত বসু। উঠে আসে শাহনাজ খান, আশফাকউদ্দিন আহমেদ, মিস্টার কিয়ানি, মেহবুব আহমেদ প্রমুখ স্বাধীনতা সংগ্রামীর কথা। তাঁর বক্তব্যে আজাদ হিন্দ ফৌজের ছোট ছোট ব্যাটেলিয়নে কিভাবে বিভিন্ন ভাষা ও জাতি-ধর্মের প্রতিনিধি থাকত, সেকথাও বলেন সুগত বসু।
তিনি বলেন, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু বিশ্বাস করতেন ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সার্বিক ঐক্য ও মিলন দরকার। এটাকে তিনি বলতেন ‘কালচারাল ইন্টিমেসি’ বা সাংস্কৃতিক-সান্নিধ্য। তিনি বলেন, কলকাতা থেকে নেতাজির মহানিষ্ক্রমণের পথে নেতাজির পাশে ছিলেন তার ভাতুষ্পুত্র শিশির কুমার বসু এবং মিয়া আকবর খাঁ। হিন্দু-মুসলমান সবাই নেতাজির জন্যে প্রাণ দিতে প্রস্তুত থাকতেন। মিয়া আকবর খাঁ কিভাবে ওয়াচেল মোল্লার দোকান থেকে নেতাজিকে ছদ্মবেশ ধরার পোশাক কিনে এনেছিলেন সে কোথাও তুলে ধরেন তিনি। নেতাজির ডুবোজাহাজের সঙ্গী আবিদ হাসান ও আজাদ হিন্দ ফৌজের দিল্লি চলো অভিযানের টুকরো টুকরো ঘটনা তুলে ধরেন সুগত বসু। তিনি বলেন, নেতাজী কখনও অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করতেন না।
পরে প্রশ্নোত্তর পর্বে হিজাব থেকে শুরু করে ইউনিফর্ম সিভিল কোড ইত্যাদি নিয়ে সরব হন সুগত বসু। তার কথায়, ইউনিফর্মিটি এবং ইউনিটিকে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। এভাবে জোর করে কিছু হয় না। যে যার মত নিজের স্বকীয়তা বজায় রাখতে পারে, এটাই নেতাই চেয়েছিলেন। তারপরেই নুহ্ এবং মণিপুরের প্রসঙ্গ উঠে আসে তাঁর কথায়।
সুগত বসুর আক্ষেপ, বর্তমানে ইতিহাসকে ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। যাদের স্বাধীনতার সংগ্রামের কোনও ভূমিকা ছিল না, তাদেরকে বড় করে দেখানোর চেষ্টা চলছে। এ প্রসঙ্গে তিনি শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নাম নিয়ে বলেন, শ্যামাপ্রসাদ একদিনের জন্যেও জেলে যাননি আর শরৎচন্দ্র বসু ১৯৩২ থেকে ১৯৩৫, ১৯৪১-৪৫ সাল পর্যন্ত বন্দি থেকেছেন। এ নিয়ে তাঁর অভিমত, রাষ্ট্র আমাদের এগুলো ভুলিয়ে দিতে চাইবে কিন্তু আমাদের ঠিক করতে হবে কারা হবেন আমাদের রোল মডেল।
অন্যদিকে আহমদ হাসান ইমরান তাঁর বক্তৃতায় সুগত বসুর বক্তব্যের প্রশংসা করেন। তিনি অন্য প্রসঙ্গে বলেন, নেতাজীকে আমরা যেভাবে বিভিন্ন লেখায় জানতে পেরেছি, তিনি অসাধারণ মানুষ ছিলেন।
আমি বিশ্বাস করি বেঙ্গল-প্যাক্ট যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হতো, তাহলে হয়তো বাংলা ভাগ হতো না। ইমরান আরও বলেন, চিত্তরঞ্জন দাস এবং নেতাজির জীবনে আদর্শ আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করে। বর্তমানে ইউসিসি এবং হিজাব নিয়ে যা হচ্ছে সে সম্পর্কে ইমরান বলেন, যে হিজাব পরতে চায় না সে পরবে না, আর কেউ চাইলে তাকে আমরা বাধা দেবো কেন?
হরিয়ানার নুহ্-এর সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার পরিবেশকে নিছক বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় বলে উল্লেখ করেন ইমরান। তিনি বলেন, পুলিশ সব জানত। ফেসবুকে কি সব হচ্ছিল তা প্রশাসন নজরে রাখে না! মণিপুরে খুকীদের মেরে বের করে দেওয়ার ঘটনাকে ২০০২ সালের গুজরাত দাঙ্গার পুনরাবৃত্তি বলে দাবি করেন ইমরান। একইসঙ্গে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিয়ে সুভাপ্রসন্নের মন্তব্যকে এ দিন কটাক্ষ করে ইমরান আন্ডা, নাস্তা, পানি বা দাওয়াত নিয়ে যে সাম্প্রদায়িকীকরণ করার নিন্দা করেন। এ দিনের অনুষ্ঠানের সার্বিক প্রশংসা করেন ড. জয়ন্ত সেনগুপ্ত।