আহমদ হাসান ইমরানঃ বিশ সাল বাদ! হ্যাঁ– ২০ বছর ধরে আফগানিস্তানে অন্যায় দখলদারি বজায় রেখে কাবুল বিমানবন্দর দিয়ে পালিয়ে গেল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ ন্যাটো সেনারা। এরাই নাকি বিশ্বের সবথেকে শক্তিশালী সামরিক শক্তি। আফগানিস্তানের মতো একটি ছোট দেশকেও এরা পরাজিত করতে পারল না। আর বকলমেও দখলদারি বজায় রাখতেও ব্যর্থ হল। যে তালিবান সরকারের হাত থেকে মার্কিন হানাদার বাহিনী আফগানিস্তানের দখল ছিনিয়ে নিয়েছিল– তাদের সঙ্গে সমঝোতা করেই তাদের কাছে আফগানিস্তানকে ফের তুলে দিতে বাধ্য হল মার্কিন বাহিনী।
পাঠকের হয়তো স্মরণ থাকতে পারে– কেন মার্কিন স্থল সেনারা তাদের বিমান ও নৌবাহিনী নিয়ে সগর্বে আফগানিস্তানের দখল নিয়েছিল? তাদের বক্তব্য ছিল– ৯/১১-তে যে ট্যুইন টাওয়ার ধ্বংস হয়েছে তার পিছনে নাকি ছিল তালিবান মদদ আর হাত ছিল সোভিয়েত রাশিয়ার দখলদারির বিরুদ্ধে বীর মুজাহিদ ওসামা বিন লাদেনের। এ কথা ঠিক– বহু সাধ্য-সাধনা এবং বহু ক্ষয়ক্ষতি বহন করে ল্যাজেগোবরে হয়ে শেষপর্যন্ত ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করতে সক্ষম হয় মার্কিন বাহিনী।
কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, সুবিচারকামী– আইনের শাসনে বিশ্বাসকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেন প্রায় নিরস্ত্র ও অসহায় ওসামা বিন লাদেনকে গ্রেফতার না করে তাঁকে হত্যা করল, শুধু তাই নয়– ওসামা বিন লাদেনের লাশটিকেও তারা কোথায় রেখেছে– নাকি সমুদ্রে ভাসিয়ে দিয়েছে তারও কোনও হদিশ মার্কিনিরা প্রকাশ করেনি। অর্থাৎ ওসামা বিন লাদেনের লাশের প্রতিও তাদের ভয় ও আতঙ্ক কম নয়।
প্রথম থেকেই কিন্তু তালিবানরা অস্বীকার করে আসছিল যে– টুইন টাওয়ারের ধ্বংসযজ্ঞে ওসামা বিন লাদেনের কোনও ধরনের হাত রয়েছে এমন কোনও প্রমাণ তাদের কাছে নেই। আর তালিবান নেতৃত্ব এও বলেছিল– যদি ওসামা বিন লাদেনের অপরাধ সম্পর্কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কোনও প্রমাণ থাকে– তাহলে তা যদি তালিবান সরকারের হাতে তুলে দেওয়া হয় সেক্ষেত্রে তারা ওসামা বিন লাদেনকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে সমর্পণ করবে। কিন্তু মার্কিনিরা তালিবানদের কাছে কেন– সারাবিশ্বের কাছেও কোনও অকাট্য প্রমাণ রাখতে পারেনি।
তখনই কিন্তু প্রশ্ন উঠেছিল– ইন্টারনেট ও মোবাইল টেলিফোন বিহীন ওসামা বিন লাদেন কী করে আফগানিস্তান থেকে সুদূর আমেরিকায় আক্রমণ পরিচালনা করবেন? কিন্তু কে শোনে কার কথা! টুইন টাওয়ার ধ্বংসে দিশাহীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘শত্রু ‘চাই। বহু খুঁজে তাঁরা ‘পুরনো মিত্র’ ওসামা বিন লাদেনকে চিহ্নিত করেছে। হাতের কাছে আর অন্য কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। তাই ওসামা বিন লাদেনই সই। কিন্তু তাদের স্যাটেলাইট নজরদারি– সিআইএ– এফবিআই থাকা সত্ত্বেও ওসামা বিন লাদেনকে খুঁজে বের করতে কালঘাম ছুটে গিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্টেÉর। তারপর এক অভিযান চালিয়ে লাদেনকে হত্যা করা হয়। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তালিবানদের হাতে ফের ক্ষমতা সঁপে দিয়ে পিঠটান দেওয়ার সময়ও তালিবানরা কিন্তু পুনরায় সাফ জানিয়ে দিয়েছে– ৯/১১-র টুইন টাওয়ার ধ্বংসের সঙ্গে ওসামা বিন লাদেনের কোনও সম্পর্কই ছিল না।
তাহলে এত প্রাণহানি– এত অর্থ ব্যয় এ সব কিছুই কি বৃথা গেল? মার্কিন যুক্তরা ও ন্যাটো বাহিনী একদিকে যেমন আফগানিস্তানের শিশু ও বালক-বালিকা– বৃদ্ধ– নারী-পুরুষকে তাদের কোনও অপরাধ ছাড়াই অকাতরে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে– বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার অর্থ ব্যয় করেছে– পরিবেশের ধ্বংস সাধন করেছে আর অসংখ্য গানিব্যাগে নিজ সৈন্যদের লাশ নিয়ে গেছে নিউ ইয়র্ক ও ওয়াশিংটনে। এর বিনিময়ে তারা কি হাসিল করল? বিশ সাল বাদ তাদের তো রাতের অন্ধকারে পালাতে হল! পালাতে হল যুদ্ধাস্ত্র ও বিমান বাহিনী ফেলে। সারাবিশ্বের কাছে নিজের ও নিজেদের বলদৃপ্ত (!) সেনাবাহিনীর মুখ পুড়িয়ে। মার্কিন– ব্রিটেন– ফ্রান্স– জার্মানি– ইতালি– অস্ট্রেলিয়া সবকটি পশ্চিমা দেশ তো এক হয়ে আফগানিস্তানে ‘যুদ্ধ যুদ্ধ’ খেলতে এসেছিল। আর খেলতে খেলতেই তাদেরকে পালাতে হল অনেক লাশ বলি দিয়ে। দুঃখের কথা– সব লাশকে তারা স্বদেশে নিয়ে যেতেও পারেনি।
গত দুই শতাব্দীতে আর কোনও যুদ্ধে এতবেশি ক্ষয়-ক্ষতি– ব্যর্থতা ও অপমান স্বীকার করতে হয়নি পশ্চিমা সরদার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
তাহলে বিশ বছর ধরে একটা দুর্বল– দরিদ্র দেশ আফগানিস্তান কীভাবে লড়ল এই পরাশক্তিগুলির বিরুদ্ধে? তালিবানরা বলছেন– তাদের তেমন কিছুই ছিল না। তারা নানাভাবে অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করেছে। আর তাদের সব থেকে বড় অস্ত্র ছিল ঈমানিশক্তি– আল্লাহ্তে বিশ্বাস এবং জীবন দিতে ভয় না পাওয়া। অন্যদিকে– মার্কিন ও পশ্চিমা সেনারা জীবন দেওয়ার প্রশ্নে ছিল একেবারেই ভয়ের তলদেশে। তারা লড়তে চাইত ক্ষেপণাস্ত্র– বিমান ও হেলিকপ্টার দিয়ে। যেন লড়তে নামলেও কোনওভাবেই মরতে না হয়।
এখনও পর্যন্ত কিন্তু সঠিকভাবে জানা যায়নি কে বা কারা টুইন টাওয়ার ধ্বংস করেছিল? কী করে প্রযুক্তিগতভাবে এত এগিয়ে গিয়ে শত্রুরা টুইন টাওয়ার নিখুঁতভাবে ধ্বংস করল! অনেকে এই টুইন টাওয়ার ধ্বংস ঘিরে নানা ‘কন্সপিরেসি থিওরি’ বাজারে ছেড়েছেন। এই বইগুলিও আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি হচ্ছে দেদার। অনেকে আবার বলছেন– সউদি আরব সব কিছু জানত। আবার বেশিরভাগই অঙ্গুলি নির্দেশ করছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান চালিকাশক্তি জায়নবাদী ইসরাইলের দিকে। সে যাই হোক– সত্য একদিন হয়তো উদ্ঘাটিত হবে। এই মুহূর্তে সব থেকে বড় কথা– আফগানিস্তানে ফের সূর্যোদয় হয়েছে। মুক্ত বাতাসে নিশ্বাস নিচ্ছেন বীর আফগানরা ও আফগানিস্তানের পরবর্তী প্রজন্মের শিশুরা।