প্রসেনজিৎ দত্ত: এ লেখা ছাপতে যাওয়ার মুহূর্তে টিভির পর্দায় মৃত্যুর সংখ্যা হয়তো তিনশো পেরিয়ে যাবে। আহত সংখ্যা হয়তো চার ডিজিট ছুঁয়ে ফেলবে। ওড়িশার বালাসোর জেলায় শুক্রবারের ট্রেন দুর্ঘটনা গত ২০ বছরের মধ্যে ভারতের সবচেয়ে মারাত্মক রেল দুর্ঘটনা। আনুমানিক ৯০০ জন আহত হয়েছেন।
এমন ভয়ানক দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ প্রভাব রয়েছে। পরোক্ষ প্রভাব পড়েছে হিন্দুদের তীর্থস্থান পুরীতেও। ২ জুন সন্ধ্যায় দুর্ঘটনার পর কলকাতা থেকে পুরীগামী সমস্ত ট্রেন বাতিল করা হয়। ফলে বহু তীর্থযাত্রীরই জগন্নাথ দর্শনের ইচ্ছা অপূর্ণ থেকে যায়। রবিবার, অর্থাৎ ৪ জুন রয়েছে জগন্নাথের স্নানযাত্রা। বিষ্ণুর অবতার জগন্নাথ, তাঁর ভাই বলরাম এবং সুভদ্রাকে স্নান করানো হয় এই দিনে। বহু পুণ্যার্থী এই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেন। তাই স্বাভাবিকভাবেই এই দিনকে ঘিরে জমজমাট থাকে পুরী।
কিন্তু পরিস্থিতিটা একদম ভিন্ন যেসব তীর্থযাত্রীরা ইতিমধ্যেই পুরীতে রয়েছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে। তাঁরা ফিরবেন কীভাবে? আইআরসিটিসি থেকে যাঁরা টিকিট কেটেছেন, তাঁরা ট্রেন বাতিল হওয়ার খবর এসএমএস এবং ই-মেলের মাধ্যমে সকাল ১১টার পর। ফলে অনেকটাই সময় পেরিয়ে যায়। যাঁরা কাউন্টার থেকে টিকিট কেটেছেন, তাঁরা রেল এনকোয়ারিতে ফোন করে করে নাজেহাল হয়েও সঠিক তথ্য পাননি।
পুরীতে স্নানযাত্রা দেখতে আসা মাঝবয়সি রীতা আদক বলেন— ‘চারদিক থেকে যা খবর পাচ্ছি, তাতে পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক হবে বুঝতে পারছি না। স্নানযাত্রা তো কাল। এর টানেই আসা। কিন্তু বাড়ি ফিরব কীভাবে?’ জানলাম, তাঁর স্বামী সেই ভোরবেলা থেকে একটা টোটো রিজার্ভ করে পুরী বাসস্ট্যান্ডসহ ইতিউতি বহু জায়গায় হন্যে হয়ে ঘুরেছেন। ডলফিন প্রাইভেট লিমিটেডের বাসে ফেরার ইচ্ছে ছিল তাঁদের। কিন্তু আগামী দু-দিন বাসের কোনও সিট অবশিষ্ট নেই। শ্যামলী কিংবা গ্রিন লাইন কোম্পানির বাসের অবস্থাও একই। তার উপর ভাড়াও প্রায় তিন গুণ। বাসের একটা সিট পাওয়ার জন্য আকুল অবস্থা রীতাদেবীর পরিবারের মতো অসংখ্য পরিবারের। আর চার চাকার গাড়ি রিজার্ভ করে যাওয়ার মতো আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য যাঁদের আছে, তাঁদের অবস্থা বুঝে কোপ মারছেন স্থানীয় ট্র্যাভেলার কোম্পানিও। কিলোমিটার প্রতি তারা দর হাঁকছে কখনও ৩০, কখনও ৩৫, ৪০।
বালাসোর (বালেশ্বর)-এর কাছাকাছি এসে করুণ দৃশ্য দেখা গেল। রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে বহু শববাহী যান। চোখে পড়ছে অ্যাম্বুলেন্সের মুহুর্মুহু আসা-যাওয়া। রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে ‘ট্রেন রেসকিউ’ লেখা বাসও। পিছনে পুলিশ ভ্যান। বাসের যাত্রীরা সুরক্ষিত। তাঁদের প্রাথমিক চিকিৎসার পর হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তবে, যাঁরা এখনও দুর্ঘটনাস্থল থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি, তাঁদের আশু প্রয়োজন ত্রাণ। জানা গেল, ৯টি এনডিআরএফ টিম, ৫টি ওডিআরএএফ ইউনিট এবং ২৪টি ফায়ার সার্ভিস ও ইমার্জেন্সি ইউনিট উদ্ধারকাজে নিয়োজিত। রাতে অপারেশনের জন্য টাওয়ারের আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।
চিকিৎসার জন্য দুর্ঘটনাস্থলে ওষুধ ও প্যারামেডিক্যাল স্টাফসহ ১০০-রও বেশি মেডিক্যাল টিম পাঠানো হয়েছে। ২০০-রও বেশি অ্যাম্বুলেন্স বিভিন্ন স্টেশনে আটকে পড়া যাত্রীদের জন্য খাবার এবং পানীয় জলের ব্যবস্থা করে হাসপাতালে স্থানান্তর করতে নিযুক্ত। ৩০টি বাস আটকে পড়া যাত্রীদের চলাচলের জন্য নিযুক্ত করা হয়েছে। প্রায় হাজার আহত মানুষকে সোরো, বালাসোর, ভদ্রক এবং কটকের হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। সরকারিভাবে আহতদের বিনামূল্যে চিকিৎসা এবং বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
খবর পেলাম ঘটনাস্থলে গতকালই পৌঁছে গিয়েছেন ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়েক। আজ এসেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দেশের দক্ষিণ প্রান্ত থেকে আসা ট্রেন। খুব স্বাভাবিক কারণে সেই ট্রেন ভর্তি ছিল ভেলোর, চেন্নাই, বেঙ্গালুরু থেকে চিকিৎসা করিয়ে ফেরা প্রচুর বাঙালি।
আরোগ্য লাভ করে অনেকেরই আর বাড়ি ফেরা হল না। অনেকেই হয়তো হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে ফিরছিলেন। চূড়ান্ত আহত হয়ে আবার আশ্রয় নিতে হল হাসপাতালের বেডে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এমন যে, ভারতের রেলের ইতিহাসে এক ভয়ানক পর্ব হিসেবে এই দুর্ঘটনা লিপিবদ্ধ হয়ে থাকবে তাতে সন্দেহ নেই। সন্দেহ নেই।