গোলাম রাশিদ: শুক্রবার ইন্তেকাল করেছেন বিশিষ্ট লেখক ও অধ্যাপক ড. ওসমান গনী, ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রজিউন। বাঙালি মুসলিমদের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক জগতে তিনি ছিলেন এক শীর্ষস্থানীয় চিন্তাবিদ।
নির্ভরযোগ্য ও প্রামাণ্য ইসলামি ইতিহাস,সামাজিক নানা বিষয় নিয়ে তাঁর সৃষ্টিশীল লেখা ঋদ্ধ করেছে দুই বাংলার সমাজকে। দীর্ঘ অধ্যাপনা জীবনে নিষ্ঠার সঙ্গে তিনি ছাত্রছাত্রীদের পড়িয়েছেন। সেজন্য ছাত্রমহলেও তাঁর তুমুল জনপ্রিয়তা ছিল।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম ডি-লিট ছিলেন তিনি। এছাড়াও বহু পুরস্কার ও স্বীকৃতি পেয়েছেন তিনি। ছিলেন রামতনু লাহিড়ী স্কলার, ইউজিসির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো। করেছিলেন পিএইচডি। তাঁর মৃত্যুতে বাংলার শিক্ষা ও সমাজজগৎ এক অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হল।
শুক্রবার দুপুর ২টো ২৫ মিনিটে পার্ক সার্কাসের ২৯ এ ফজলুল হক সরণীর ঝাউতলা রোড, বাড়িতে তিনি ইন্তেকাল করেন। এই খবরে বাংলার গুণী ও অনুরাগী মহলে নেমে এসেছে শোকের ছায়া।
আজ শনিবার যোহরের নামাযের পর পূর্ব বর্ধমানে তাঁর নিজ গ্রাম কাঁটাডিহিতে নামায-এ-জানাযা ও দাফনকাজ সম্পন্ন হবে বলে জানিয়েছেন লেখকের নাতি নাসিম আলি।
অধ্যাপক গনী পরিবারে রেখে গেলেন এক কন্যা, পুত্র অধ্যাপক ড. কাশশাফ গনী ও সহধর্মিনী শওকত আরা গনীকে। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর।
অবিভক্ত ভারতের বর্ধমানের কাটোয়া মহকুমার কেতুগ্রামের কাঁটাডিহিতে ১৯৩৫ সালের ১ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন মুহাম্মদ ওসমান গনী। পিতা মুহাম্মদ ইউনুস। তাঁর শিক্ষা ও কর্মজীবন যেকোনও মানুষের কাছেই শিক্ষণীয়। ছাত্রজীবনে মেধাবী হিসেবেই পরিচিতি ছিল তাঁর। একজন বুদ্ধিজীবী হিসেবে বহু গ্রন্থ রচনার পাশাপাশি তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে নানা দায়িত্ব সামলেছেন।
মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হয়েছিলেন। এছাড়াও পশ্চিমবঙ্গ কলেজ সার্ভিস কমিশন, ওয়াকফ বোর্ড, যোজনা কমিশন, আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড মেম্বারও ছিলেন তিনি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘ সময় অধ্যাপনাকালেই তাঁর খ্যাতি ছড়িয়েছিল চারদিকে। এই ইউনিভারসিটির ইসলামি ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর সম্বন্ধে আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘ওসমান গনী পিএইচডি, ডি-লিট, আমার অন্যতম প্রিয় ছাত্র। আরবি, ফারসি, উর্দু, বাংলা ও ইংরেজিতে সুপণ্ডিত।’
ভাষাবিদ ড. সুকুমার সেনও ওসমান সম্বন্ধে প্রশংসা করেছেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘ওসমান গনীর অসাধারণ লেখনি বিষয়বস্তুর যুক্তিতে ও চিন্তার যুক্তিতে এবং আপন মৌলিকত্বে ইসলামকে স্থান-কাল-পাত্রভেদে সংকীর্ণতার সীমান্ত পার করিয়ে গণ্ডিত্তীর্ণ করিতে সক্ষম হইয়াছে।’
বিভাগ পরবর্তী এপার বাংলায় মুসলিম সমাজের সংস্কৃতি ও শিক্ষা জগতে এক শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল। সেই জায়গায় অধ্যাপক ড. ওসমান গনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। ইসলামের সঠিক ইতিহাস রচনা, কুরআনের সঠিক বঙ্গানুবাদ, হাদিসের বঙ্গানুবাদ, ইসলামের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার পথকেই তিনি বেছে নিয়েছিলেন এই প্রেক্ষিতে। এই কাজে প্রায় একা সৈনিক হয়ে সারাজীবন তিনি লড়াই করে গিয়েছেন। তাঁর একেকটি গ্রন্থ দুই বাংলার পাঠক মহলে বিপুল সাড়া জাগিয়েছে।
‘পুবের কলম’ পত্রিকাতেও তিনি বেশকিছু নিবন্ধ লিখেছেন। ইতিহাসের নীরস বিষয়কে তিনি সহজভাবে সাধারণ পাঠকের উপযোগী করে লিখতেন। ‘কোরয়ান শরীফ বঙ্গানুবাদ ও ব্যাখ্যা’ ‘কোরয়ানের অভিধান’, চরিত্র ও সমাজ গঠনে কোরয়ান শরীফ-চরিত্র ও সমাজ গঠনে হাদিস শরীফ, ‘পবিত্র কোরয়ান সামাজিক সংবিধান’ ‘ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ’ ‘ইসলাম ও সুফীসমাজ ‘ ‘ইসলাম ও নারীসমাজ’, ইসলামে চিন্তা ও চেতনার ক্রমবিকাশ-এর মতো গ্রন্থ ছাড়াও ড. ওসমান গনী মহানবী সা., হযরত আবুবকর রা., হযরত ওমর ফারুক রা., হযরত ওসমান গনী রা., ‘হযরত আলী রা.’-এর প্রামাণ্য জীবনী লিখেছেন।
লিখেছেন ‘উমাইয়া খেলাফত’, ‘আব্বাসীয় খেলাফত’ ‘স্পেনের মুর খেলাফত ‘ ‘তুরস্কের ওসমানিয়া খেলাফত’ শীর্ষক ঐতিহাসিক গ্রন্থ।
এভাবেই তিনি ইসলামের ধারাবাহিক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস লিখেছেন। তাঁর মতে, পবিত্র কুরআনের মানবতাবাদী দর্শনে তুলে ধরা জীবনই সমাজবদ্ধ মানুষের শ্রেষ্ঠ অবলম্বন। স্রষ্টা মনোনীত সর্বশেষ এই ঐশী গ্রন্থের শাশ্বত বাণীই হল মানবসমাজের আদর্শ সংবিধান।