সেখ কুতুবউদ্দিন: চাকরি অথবা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে সংখ্যালঘুদের সংরক্ষণ দেওয়ার আইন করেছে সরকার। সেই আইন লাগু করার জন্য অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ দফতর থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে নির্দেশিকাও জারি করা হয়েছে। সেই নির্দেশ অনুসারে রিজার্ভেশন নিয়ম মেনে চাকরি ও ভর্তির প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হচ্ছে না বলে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। এবার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগের ক্ষেত্রে সংরক্ষণ নিয়ম পুরোপুরি কার্যকর হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠল।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রের খবর সংরক্ষণের ক্ষেত্রে সরকারি নিয়ম থাকলেও সেই আইন লঙ্ঘন করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ সহ ভর্তিতে বিভাগ অনুসারে কমিটি গঠিত হয়। সেই কমিটিতে বিভাগের প্রধান-সহ অন্যান্যরা থাকেন। নিয়োগের বিষয়টিও এই কমিটিগুলির উপর ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু যাদবপুরের অধিকাংশ বিভাগের কমিটিতে কোনও সংখ্যালঘু প্রতিনিধিকে রাখা হয় না বলেও অভিযোগ। নিয়োগের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের আগে ওই কমিটিগুলিই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়। আর এ নিয়ে নিয়োগের পাশাপাশি পিএইচডি, এমফিলে ভর্তির ক্ষেত্রেও ওবিসি সংরক্ষণ নিয়ে চরম বঞ্চনার অভিযোগ তুলেছেন ছাত্রছাত্রী থেকে শুরু করে আবেদনকারীদের একাংশ। এ দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে পিএইচডির ভর্তিতে রোস্টার মানার কথা বলা আছে। কিন্তু সেই রোস্টার অনুসারে ভর্তি নেওয়া হচ্ছে না বলে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা বিভাগের পড়ুয়াদেরই অভিযোগ।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা বিভাগের এক গবেষকের কথায়, প্রতি বছর প্রত্যেক বিভাগে ৫ থেকে ৮টি করে আসন থাকে। সেই আসনে ওবিসি এ ওবিসি-বি-এসসি-এসটি-পিএইচ সংরক্ষণ মেনে ভর্তি নেওয়া সম্ভব হয় না। তাই পাঁচ বছরের রোস্টার তৈরি করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। পাঁচ বছরের রোস্টার অনুসারে সংরক্ষণ মেনে ভর্তির তালিকা প্রকাশ করার কথা। কিন্তু সেই নিয়মও মানা হয় না।
গবেষকদেরই অভিযোগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা বিভাগের ভর্তিতে সংরক্ষিত আসনের প্রার্থীদের ‘নট সুইটেবল’ লিখে দেওয়া হয়। তাঁদের বক্তব্য, পিএইচডির ভর্তিতে অনেক সময় মেধাবী পড়ুয়ারাও বঞ্চিত হচ্ছেন। ছাত্ররা জানাচ্ছেন, এই বিষয়ে একাধিকবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে চিঠিও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনও সদুত্তর পাওয়া যায়নি। এই অভিযোগ সংক্রান্ত বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিক্রিয়া চাওয়া হলে কোনও প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
আবার ওবিসি প্রার্থী জেনারেল ক্যাটাগরির চেয়ে বেশি নম্বর পেলেও তাকে ওবিসি সংরক্ষণের আওতাতেই রেখে দেওয়া হচ্ছে। অথচ, হিসেবমতো তাকে জেনারেল ক্যাটেগরিতে নিতে হয়। এ ধরনের কৌশল করে ওবিসি প্রার্থীদেরকে বঞ্চনা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে সায়েন্স, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং কলা বিভাগ মিলে মোট বিভাগ রয়েছে ৩২টিরও বেশি। এ ছাড়া আরও কিছু কোর্স চালু রয়েছে। এর মধ্যে শিক্ষক সং’্যা ৬০০-র অধিক। মুসলিম শিক্ষক রয়েছেন ১৫ জনের মতো। নতুন নিয়োগের ক্ষেত্রে কমিটিগুলিকে সংরক্ষণ মেনে নিয়োগ করার নির্দেশিকাও রয়েছে। কিন্তু সংরক্ষণ নিয়ম সঠিকভাবে মানা হচ্ছে না বলে অভিযোগ। এই বিষয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চাওয়া হলে বলা হয়, এই অভিযোগ লিখিতভাবে জমা পড়লে খতিয়ে দেখা হবে।
এ দিকে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ও সংরক্ষণ নিয়ম কার্যকর নিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির কাছ থেকে রিপোর্ট চেয়েছে উচ্চশিক্ষা দফতর। শিক্ষা দফতরের এক আধিকারিক জানান, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাকরিতে সংরক্ষণ কার্যকর ঠিকঠাক হচ্ছে কি না, তা জানার জন্য চাকরিপ্রার্থীদের অভিযোগের ভিত্তিতে অনগ্রসর কল্যাণ ডিপার্টমেন্ট শিক্ষা দফতরের কাছে জানতে চায়।
ব্যাকওয়ার্ড ওয়েলফেয়ার ডিপার্টমেন্টের সচিব ‘পুবের কলম’কে জানিয়েছেন, এসসি, এসটির পাশাপাশি ওবিসি ‘এ’ ১০ ওবিসি-বি-৭ শতাংশ সংরক্ষণ অনগ্রসর দফতরের নিয়ম অনুসারে কার্যকর করতে হবে। এই নিয়ে উচ্চশিক্ষা দফতরে নির্দেশিকাও পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছে অনগ্রসর দফতর।
সংশ্লিষ্ট দফতর আরও জানিয়েছে, সংরক্ষণ নিয়ম মানা হচ্ছে না, এই অভিযোগ দফতরে জমা পড়েছে। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সংরক্ষণ নিয়ম কার্যকরের বিষয়টি দেখতে শিক্ষা দফতরই। শিক্ষা দফতর বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে নির্দেশিকা পাঠায়।
সরকারি চাকরির পাশাপাশি উচ্চশিক্ষায় অনগ্রসর শ্রেণির ওবিসিদের সংরক্ষণের আওতায় আনার উদ্যোগ নেয় রাজ্য সরকার। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ওবিসিদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংরক্ষণের কথা বলেছেন। সেই সংরক্ষণ শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে সম্পূর্ণরূপে মেনে চলার দাবি তোলা হয়েছে ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের পক্ষ থেকে।
এই বিষয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক আধিকারিক জানান, প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সংরক্ষণ চালু করার ব্যাপারে রাজ্যের সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের আধিকারিকদের নিয়ে উচ্চশিক্ষা দফতরের বৈঠক হয়। সেই আলোচনায় স্থির হয়, সম্পূর্ণরূপে সংরক্ষণ কার্যকর করতে হবে। সংখ্যালঘু দফতর ও শিক্ষা কমিশনের নির্দেশ মোতাবেক তা কার্যকর করার জন্য যাদবপুরসহ সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি বিভাগকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সংরক্ষণ কার্যকরের ক্ষেত্রে গাফিলতির বিষয়টি নিয়ে কর্তৃপক্ষকে আরও কঠোর হওয়ার বার্তা দেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ছাত্রছাত্রী ও গবেষকদের একাংশ।