বিপাশা চক্রবর্তী: দীর্ঘ এ বন্ধুর পথে লড়াই এখনও অনেক বাকি। এই পথ মসৃণ নয় জেনেও নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন এক মধ্যবয়স্কা মহিলা। সেই পথে বার বার হোঁচট খেতে হয়েছে। তাও মেরুদণ্ড সোজা রেখে মানুষের পাশে থাকার কাজ করে চলেছেন মধ্যমগ্রামের নূপুর ঘোষ। নিজের একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে আজ রাস্তার ধারে পড়ে থাকা পথশিশুদের মা তিনি।
পুবের কলমের প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে নূপুর ঘোষ জানালেন, বাবা মন্টু চন্দ্র দে’ ছিলেন ফুটবল খেলোয়াড়। বলা যায় বাবার অনুপ্রেরণাতেই ছোটবেলা থেকে মানুষের জন্য কিছু করার তাগিদ তৈরি হয়েছিল। একটা স্পোর্টসম্যান স্পিরিট সব সময় কাজ করত। বাবা প্রয়াত হন, কিন্তু মানুষের জন্য কাজ করার সেই মানসিকতা মনের মধ্যে গেঁথে দিয়েছিলেন। তাই কলেজে পড়াশোনার সময় থেকেই সেই কাজ শুরু করি। বিয়ের পর জীবনে মর্মান্তিক একটি ঘটনা ঘটে। ২০১০ সালে ছেলে মারা যায়। ফুটবল খেলত গিয়ে পায়ে পেঁরেক ঢুকে যায়, অকালেই হারিয়ে ফেলি একমাত্র সন্তানকে।
নূপুর বলেন, বিয়ের পর খুব অভাবের সংসার ছিল। স্বামীর চাকরি ছিল না। ছেলে হওয়ার পর চাকরি পান স্বামী। তবে আর্থিক অনটনে সংসারের হাল ধরতে একটি চাইল্ড লেবার সংস্থায় কাজ নিই। সেটা ১৯৯৬ সাল। সেই সময় যাতায়াতের পথে ট্রেনে বাচ্চাদের জুতো পালিশ করতে দেখতাম। আর লক্ষ্য করতাম তাদের হাত আর পা’গুলি আস্তে আস্তে কর্মশক্তি হারিয়ে ফেলছে। স্কুলেও যেত না ওরা।
২০০১-এ একটি সমীক্ষা চালিয়ে আমরা দেখি, প্রায় ৮০ শতাংশ পথশিশু স্কুলে যায় না। তাদের একটাই পরিচয় তারা চাইল্ড লেবার। এমনকী জন্ম পরিচয়পত্রটুকুও তাদের নেই। এর পর বিভিন্ন কর্মসূচি পথ নাটিকার মাধ্যমে ধীরে ধীরে তাদের স্কুলের গুরুত্ব বোঝাই। এখন ওরা শিক্ষার গুরুত্ব ধীরে ধীরে বুঝছে। আজ গর্ব হয় এই রকম শিশুদের মধ্যে কেউ ইঞ্জিনিয়ার, নার্স, বিমান সেবিকাও হয়েছে। তৈরি হয়েছে ‘মধ্যগ্রাম সৃষ্টির পথে’ নামক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। আমার সঙ্গে এখন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ২২ জন সদস্য কাজ করে চলেছেন।
আমরা নারী পাচার থেকে শুরু করে বাল্য বিবাহ রোধ, নেশাগ্রস্থ শিশুদের রিহ্যাবে পাঠানোর ব্যবস্থা, শিশুদের সচেতন করা, রাস্তায় পড়ে থাকা বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সরকারি হোমে রাখার ব্যবস্থা করি। এই সংস্থার আমি সেক্রেটারি, বাপি বিশ্বাস সভাপতি। শিশুরা নিজেদের কিভাবে সুরক্ষিত রাখবে তা নিয়ে আমরা ওদের ক্লাস নিই। গুড টাচ, ব্যাড টাচ, সোশ্যাল মিডিয়ার কুফল, ক্যারাটে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পেরেছি।
নূপুর আরও জানালেন, ছেলের স্মৃতিতে একটি স্কুল গড়েছি, নাম দিয়েছি ‘সৃষ্টির পাঠশালা’। সেখানে ৪২ জন পথশিশু রয়েছে। সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারের একটি পার্কে পড়াশোনার কাজ চলে। ৪ বছরের শিশু থেকে ১৮ বছরের কিশোররা এখানে আছে। নারী পাচার রুখতে গিয়ে প্রাণনাশের হুমকিও পেয়েছি, কিন্তু লড়াই থামাইনি। ছেলে আমাকে বলে গিয়েছিল, মা বাধা আসলেও এই কাজ তুমি ছাড়বে না। তাই আজও আমার এই কাজ চলেছে।
কাজের জন্য সাধারণ মানুষের অনেক ভালোবাসা, সরকারি-বেসরকারি ক্ষেত্র থেকে সম্মান পেয়েছি। তবে কোনও সরকারি অনুদান পাই না, অনেক সময় অর্থের অভাবে আটকে গেলে নিজেকে বড় অসহায় লাগে।
মানুষ এই কাজে আরও এগিয়ে আসলে ভালো লাগত। বিবেকানন্দের মতাদর্শে হেঁটে শিশুদের চরিত্র গঠন করাই আমাদের লক্ষ্য।
নূপুর ঘোষের সঙ্গে যোগাযোগের ঠিকানাঃ
Ph-8697308037