পুবের কলম ওয়েব ডেস্ক: দেশের প্রায় ১৫,২০০ কিলোমিটার সীমানা জুড়ে রয়েছে আন্তর্জাতিক সীমারেখা। কড়া পাহারায় থাকে ‘অতন্দ্র প্রহরী’ বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স বা বিএসএফ। তা সত্ত্বেও সীমান্ত দিয়ে অবৈধ চোরাচালান, নারীপাচার, বন্দুক পাচার, মাদক ব্যবসা, কয়লা পাচার ও সন্ত্রাসী কার্যলাপ বন্ধ হয়নি। সীমান্ত দিয়ে জাল টাকার আদান প্রদান এবং হাওয়ালাও হয় বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক ও বিএসএফ-এর অভিযোগ।
পাকিস্তান সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে এ দেশে ঢুকে হামলা চালানোর অভিযোগও রয়েছে। চিন সীমান্তে রয়েছে লাল ফৌজের চোখরাঙানি। বাংলাদেশ বর্ডার দিয়ে গরুপাচারের অভিযোগ শোনা যায়। অনেক সময় গরু পাচারকারী সন্দেহে বিএসএফ এলোপাথাড়ি গুলি চালিয়ে বহু মানুষকে হত্যা করেছে। কিন্তু সীমান্ত অপরাধের সুরাহা হয়নি। কেন্দ্র দোষারোপ করেছে রাজ্যগুলিকে। কিন্তু রাজ্যের বক্তব্য, সীমান্ত পাহারায় রয়েছে কেন্দ্রের বিএসএফ বাহিনী। তারপরও কেন অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে? এর দায় কার?
এবার অবশ্য পুরো বিষয়টিতে এক নতুন সংযোজনের প্রস্তাব এসেছে। কেন্দ্র কালাকানুন বলে কথিত ‘ইউএপিএ’ বল ঠেলেছে রাজ্যগুলির কোর্টে।
আন্তর্জাতিক সীমান্ত অপরাধীদের বিরুদ্ধে কি কঠোর বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইন বা ইউএপিএ কানুন ব্যবহার করা উচিত হবে? কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক তাদের এই প্রস্তাব সমস্ত রাজ্য সরকারের কাছে পাঠিয়েছে এবং জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যুতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে একটি বিস্তারিত মতামত চেয়েছে।
তবে এই আইন সীমান্তের চোরাচালানকারীদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করার কথা হলেও সাধারণ মানুষের মানবাধিকারে হস্তক্ষেপ হতে পারে বলে আশঙ্কা ব্যক্ত করা হযেছে। সীমান্তে ‘ইউএপিএ’ আইনটির অপপ্রয়োগ হতে পারে। আর সেক্ষেত্রে এক জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
ইউএপিএ অত্যন্ত কঠোর আইন। সন্ত্রাসী কার্যকলাপ মোকাবিলা করার জন্য ব্যক্তি ও সংগঠনের বিরুদ্ধে এটি প্রয়োগ করা হয়। এই আইনবলে সন্দেহের বশে কোনও ব্যক্তিকেও সন্ত্রাসবাদী তকমা দিয়ে গ্রেফতার করা যায়। পুরনো ইউএপিএ আইন অনুযায়ী কোনও সংগঠন সন্ত্রাসী কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত থাকলে, সন্ত্রাসী কাজকর্মের প্রস্তুতি নিলে এবং তাদের মাধ্যমে কোনওভাবে সন্ত্রাসবাদের প্রচার হলে, ওই সংগঠনকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ বলে চিহ্নিত করতে পারত কেন্দ্রীয় সরকার। ওই সংগঠনের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে পারত এনআইএ। কিন্তু নরেন্দ্র মোদি সরকার সেই আইনের সংশোধন ঘটিয়েছে বছর তিনেক আগে।
এখন এই আইনবলে শুধুমাত্র কোনও সংগঠনই নয়, সন্দেহভাজন কোনও ব্যক্তিকেও সন্ত্রাসবাদী তকমা দিয়ে গ্রেফতার করা যাবে। সন্ত্রাসবিরোধী আইন অনুসারে, ‘বেআইনি’ কার্যকলাপ হল এমন একটি কাজ ভারতের সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার করে বা এর বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ নেয়। আঞ্চলিক অখণ্ডতাকে ব্যাহত করার উদ্দেশ্য নিয়েও এই কাজ হতে পারে, যা ভারতের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলে, ভারতে বা বিদেশে বসবাসকারী লোকেদের মধ্যে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে।
সূত্র জানাচ্ছে, গরু পাচারকারীরা ধরা পড়লে মামলাগুলো কাস্টমসের হাতে চলে যায়। সেক্ষেত্রে অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার জন্য যথেষ্ট কঠোর আইন নেই ভারতীয় দণ্ডবিধিতে। যেহেতু আইনের তেমন ভয় নেই, তাই অনেকে এই ব্যবসার মাধ্যমে বিপুল অর্থ উপার্জন করছে বলে অভিযোগ। মাদক চোরাচালানের ক্ষেত্রে অপরাধীদের নারকোটিক ড্রাগস অ্যান্ড সাইকোট্রপিক সাবস্ট্যান্সেস অ্যাক্টের (এনডিপিএস) অধীনে মামলা করা হয়।
এসবের প্রেক্ষিতে, কেন্দ্রের ইউএপিএ প্রস্তাবের মূলমন্ত্র হল কঠোরতার সঙ্গে আন্তর্জাতিক অপরাধ দমন করা এবং চোরাকারবারীদের মধ্যে ভয় জাগানো। এ প্রসঙ্গে একজন প্রাক্তন বিএসএফ অফিসার বলেছেন, ‘ইউএপিএ একটি অত্যন্ত কঠোর আইন যা মানবাধিকার হরণ করতে পারে। সীমান্তের মানুষদের মানবাধিকার উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়াতে পারে। তবে এমন কিছু ক্ষেত্র রয়েছে, যেখানে এটি আরোপ করা যেতে পারে। জাতীয় নিরাপত্তাকে প্রভাবিত করে এমন অপরাধ ইউএপিএ-এর আওতায় আনা যেতে পারে। দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য জাল মুদ্রা, মাদক বা অস্ত্র চোরাচালানের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে এর অধীনে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’
এ দিকে ওয়াকিফহাল মহল বলছে, গরুপাচার নিয়ে প্রবল শোরগোল শুরু হওয়ার পর পুলিশ ও বিএসএফ গরুপাচার প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। যখন পশ্চিমবঙ্গ দিয়ে গরুপাচার তুঙ্গে ছিল, তখন যদি গরুপাচারকারীদের বিরুদ্ধে এই আইনটি লাগু হত, তাহলে বোধহয় ভালো হত। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ভারতীয় মনোভাব দেখে নিজেরাই প্রচুর পরিমাণে গরুর ফার্ম তৈরি করেছে। আর সেখান থেকে যে গরু বাজারে আসছে, তাতে বাংলাদেশের চাহিদার একটা বড় অংশ পূরণ হয়ে যাচ্ছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশের এক কর্মকর্তা বলেছেন, আমাদের ভারতীয় গরুর এখন আর প্রয়োজন নেই। এবার কুরবানী উপলক্ষেও ভারত থেকে খুব বেশি গরু বাংলাদেশে যায়নি। এক সমীক্ষায় জানা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গ থেকে যে গরুগুলি বাংলাদেশে পাচার হত, তাতে পাচারকারীদের সঙ্গে বিএসএফও সমানভাবে জড়িত ছিল। আসলে এই গরুগুলি আসে হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ এমনকী মহারাষ্ট্র, রাজস্থান এবং গুজরাত থেকেও। যেসব গরু দুধ দেওয়া বন্ধ করে দেয় এবং প্রজনন ক্ষমতা হারায়, তাদেরকেই চাষিরা পাচারকারীদের কাছে বিক্রি করে দেয়। এখন পাচার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গুজরাত, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান প্রভৃতি রাজ্যে সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। এত সব গরুর খাবার ও থাকার ব্যবস্থা করতে পারছে না সরকার। চাষিরাও আর এদের ভরণপোষণ করতে রাজি নয়।
আর একটি কথাও উল্লেখযোগ্য। যে পরিমাণ নেশা দ্রব্য গুজরাত, মহারাষ্ট্র এবং পঞ্জাবে সমুদ্র সীমানা ও স্থলসীমান্ত থেকে ভারতে আসে, বাংলাদেশ থেকে সেই তুলনায় খুব কমই আসে। অস্ত্রের ক্ষেত্রেও সেই একই কথা প্রযোজ্য।
এ ছাড়া কেউ দেশবিরোধী কার্যকলাপ করলে তার বিরুদ্ধে এবং বহু সাধারণ ক্ষেত্রেও ইউএপিএ প্রয়োগ করা হচ্ছে দেদারভাবে। সাংবাদিকরা কোনও রিপোর্ট করতে চাইলে তাদের উপরও ইউএপিএ প্রয়োগ করা হচ্ছে। কাজেই হঠাৎ সীমান্ত এলাকায় ইউএপিএ প্রয়োগ করার প্রস্তাব সম্পর্কে ওয়াকিফহাল মহলের মত হচ্ছে, এই কঠোর আইনটি অপপ্রয়োগের সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।