বিশেষ প্রতিবেদক: অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ডের জেনারেল সেক্রেটারি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলেম ও ফিকাহবিদ মাওলানা খালিদ সাইফুল্লাহ রহমানি সাহেবের উপস্থিতিতে কলকাতার মিল্লি আল-আমীন কলেজের অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত হল ল’ বোর্ডের এক প্রতিনিধি সম্মেলন।
এই অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন ইমামে ঈদাইন ক্বারী ফজলুর রহমান সাহেব। মাওলানা খালিদ সাইফুল্লাহ রহমানির পরামর্শ মতো এই প্রতিনিধি সম্মেলনের বিষয় ছিল ‘ইত্তেহাদ-ই-মিল্লাত’ বা মিল্লাতের ঐক্য।
মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ড হচ্ছে ভারতবর্ষের মুসলিমদের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ একটি জোট সংগঠন। এই সংগঠনের মধ্যে রয়েছে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ জামায়াতে ইসলামী, আহলে হাদিস, শিয়া সংগঠন প্রমুখ। এইসব সংগঠনের নেতৃবৃন্দ মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন।
বক্তব্য রাখেন জামায়াতে ইসলামীর সাদাফ মাসুম, আহলে হাদিসের মাওলানা জাকি মাদানি, পুবের কলম পত্রিকার সম্পাদক আহমদ হাসান ইমরান, মাওলানা সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরি। প্রারম্ভিক বক্তব্য পেশ করেন ক্বারী ফজলুর রহমান। এই সভায় আরও অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।
সাদাফ মাসুম বলেন, আমাদের মিল্লাতের ঐক্যের জন্য বহু কাজই করতে হবে। তার মধ্যে একটি হচ্ছে, আল্লাহর পথে দাওয়াত প্রদান। সমাজে মহিলাদের অধিকারকেও তুলে ধরতে হবে। আর প্রয়োজন হচ্ছে বিবাহকে সহজ করা। শরীয়ত মেয়েদের যেসমস্ত হক প্রদান করেছে তা অবশ্যই তাদের দিতে হবে। তিনি আরও বলেন, মুসলিম সমাজে যে সামাজিক শক্তি রয়েছে, তাকেও সংহত করতে হবে। আমাদের কথা তুলে ধরার জন্য পশ্চিমবাংলায় একটিও প্রেশার গ্রুপ নেই। তা অবশ্যই গঠন করতে হবে। আর প্রয়োজন সমস্ত মানুষের জন্য খিদমতে খাল্ক্ব বা সৃষ্টির সেবা।
মাওলানা জাকি মাদানিও তাঁর বক্তব্যে মিল্লাতের ইত্তেহাদের কথা বলেন। পবিত্র কুরআন উদ্ধৃত করে তিনি ইত্তেহাদের জন্য শ্রোতাদের অনুপ্রাণিত করেন।
পুবের কলম পত্রিকার সম্পাদক আহমদ হাসান ইমরান বলেন, মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ড আমাদের ব্যক্তিগত আইন রক্ষা করার জন্য তৈরি হয়ে ছিল।
বাবরি মসজিদের মামলা সঙ্গীন হয়ে উঠলে মরহুম হযরত কাজী মুজাহিদুল ইসলাম এবং আরও অন্যান্যরা স্থির করেন মুসলিমদের বিভিন্ন বিষয়ে যেমন শিক্ষা, মসজিদ সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ মামলা, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিশা প্রভৃতি ক্ষেত্রেও ল’ বোর্ড কাজ করবে। ইমরান বলেন, আমরা যেমন বিভিন্ন মসলক, ফিরকা, শিয়া, সুন্নী প্রভৃতির মধ্যে ঐক্যের কাজ করব, ঠিক তেমনি আমাদেরকে বিভিন্ন এলাকার মুসলিমদেরও ইত্তেহাদের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে।
কেরল থেকে মণিপুর সব জায়গায় মুসলিমদের সঙ্গে রাখতে হবে। অসম, ত্রিপুরার মুসলিমদেরও ভুলে গেলে চলবে না। তিনি বলেন, অসমে প্রায় ১ কোটি ২০ লক্ষ মুসলিমের বসবাস। তাদের উপর হিমন্ত বিশ্ব শর্মার সরকার নানা ধরনের নির্যাতন চালাচ্ছে।
এনআরসি, সিএএ তো রয়েছেই, মুসলিমদের ঘরবাড়ি উচ্ছেদ, তাদের দ্বীন এবং তাহজিব থেকেও আলাদা করার চেষ্টা চলছে। অসমে প্রায় ৮০০ সরকারি মাদ্রাসা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই মাদ্রাসাগুলি তৈরি করেছিল মুসলিমরা। এখানে মুসলিম মেয়েরা এবং প্রত্যন্ত গ্রামের পড়ুয়ারা পড়াশোনা করে শিক্ষায় এগিয়ে যাচ্ছিল।
সম্প্রতি বুলডোজার দিয়ে দু’টি মাদ্রাসা ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এই সব এলাকা সম্বন্ধে মুসলিম সংগঠন এবং ল’ বোর্ডকে ভাবতে হবে, যাতে মুসলিমরা নাগরিক হিসেবে অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে। ইমরান দেশের হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি রক্ষার উপরও জোর দেন। তিনি বলেন, হিন্দু-মুসলিমে বিভেদ করার জন্য অপশক্তিগুলি চেষ্টা চালাচ্ছে।
মাওলানা সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরি ইত্তেহাদুল মিল্লাতের এই অনুষ্ঠানের জন্য মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ডকে অভিনন্দন জানান।
ক্বারী ফজলুর রহমানের নেতৃত্বে যারা এই কাজ করছেন তিনি তাঁদেরও অভিনন্দন আপনি জানান। তিনি বলেন, আমি সম্প্রতি ইরান সফর করেছি। সেখানে দেখেছি শিয়া ও সুন্নিরা মিলেমিশেই থাকছে। কিছু লোক অপপ্রচার করে। তাকে ভুললে চলবে না। মাওলানা সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরি আরও বলেন, পশ্চিমবাংলায় যে মুসলিমরা রয়েছে তাদের ৯০ শতাংশই বাংলাভাষী এবং তারা বেশির ভাগ জেলাগুলিতে থাকে। কিন্তু কলকাতার কিছু সংগঠনে বাংলাভাষীরা স্থান পায় না।
পার্সোনাল ল’ বোর্ডেও একই অবস্থা। এটা মিল্লাতের ঐক্যের জন্য ঠিক নয়। মাওলানা সিদ্দিকুল্লাহ আরও বলেন, আমরা পার্সোনাল ল’ বোর্ডের নেতা বিশিষ্ট আলেম খালিদ সাইফুল্লাহ রহমানির দেওয়া কার্যসূচিকে বাস্তবায়ন করব। …..
শিয়া আলেম বসরাভি মসজিদের ইমাম মাওলানা হাসান মেহেদি বলেন, আসলে আমাদের মধ্যে তেমন কোনও মতবিরোধ নেই। যারাই কলেমায় বিশ্বাসী তাঁরাই হচ্ছেন মুসলিম। আমাদের মধ্যে ইসলামের কোনও মৌলিক বিষয়ের বি¨ুমাত্র মতপার্থক্য নেই।
মাওলানা খালিদ সাইফুল্লাহ রহমানি তাঁর দীর্ঘ ভাষণে বলেন, পশ্চিমবাংলা সারা দেশের মধ্যে নমুনা স্বরূপ। এই অনুষ্ঠানে বাংলা ও উর্দুতে ভাষণ হয়েছে। বাংলা বিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষা। বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবাংলাসহ এই ভাষাভাষীর সংখ্যা সারা বিশ্বে এক বিরাট গুরুত্ব রাখে। আর ভারতবর্ষের আজাদির সংগ্রাম শুরু হয়েছিল নবাব সিরাজউদৌল্লাহর শাহাদতের মাধ্যমে। কিন্তু দুঃখের কথা, মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ডে বাংলাভাষীর সংখ্যা কম। এই জন্য সংযোগ ও ভাষার ব্যবধানই দায়ী। তিনি বলেন, আমরা সবাই যদি এক হয়ে একসঙ্গে বসতে পারি, তাহলে আমাদের কিশমত পরিবর্তিত হয়ে যাবে।
তিনি আজাদি দিবস উপলক্ষে ইতিহাসে যেসমস্ত আলেমরা কালাপাণি অর্থাৎ আন্দামানে বন্দি ভাবে নির্যাতন সহ্য করেছেন বা শহীদ হয়েছেন তাদের নাম উল্লেখ করেন।
এদের মধ্যে রয়েছেন শেখ-উল-হিন্দ মাহামুদ হাসান দেওবন্দি ও আল্লামা ফজলেহক খায়রাবাদি।
তিনি আরও বলেন, আমাদের মধ্যে যদি মতভেদ থাকে তবে তা কোনও খারাপ নয়, বরং ভাল। তবে মতভেদ যেন পারস্পরিক বিদ্বেষে পরিণত না হয়। যেন ইনতেশারে রূপান্তরিত না হয়। তিনি বলেন, মাওলানা হাসান মেহেদি ঠিকই বলেছেন। যেসব নিয়ে আমাদের মতভেদ রয়েছে তা মাদারে ঈমান নয়। অর্থাৎ ঈমানের অপরিহার্য অংশ নয়। আহলে বায়াতকে আমরা সকলেই শ্রদ্ধা করি, শ্রদ্ধা করি খলিফা ও সাহাবাদেরও। কাজেই মতভেদ কেন?
আসুন আমরা গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য বিষয়ের আলোচনার জন্য দাওয়াত দিই হিন্দু-মুসলিম সবাইকেই। আমরা দূষণ ও পরিবেশ নিয়ে আলোচনা করতে পারি। স্কুলছুটদের নিয়ে কথা বলতে পারি, জনগণকে পরিষেবা দেওয়ার ক্ষেত্রেও আমাদের ভূমিকা থাকতে হবে। অনেকে এখন মুসলিম মুক্ত ভারত করতে চায়। মুসলিমদের ওজনহীন করার চেষ্টা হচ্ছে। আপনারা যেকোনও দলকে ভোট দিন, কিন্তু সিদ্ধান্ত নিয়ে সবাই একসঙ্গে ভোট দিন। আমি শেষ তিনটি কথা বলব, আমাদের আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে হবে। নিজেদের মধ্যে ঐক্য কায়েম করতে হবে। মহিলাদের বলব আপনাদেরও ভূমিকা রয়েছে। আপনারা ‘কাউন্সিলিং সেন্টার’ তৈরি করুন, যাতে মামলায় না গিয়ে আমরা পারিবারিক বিবাদ নিজেরাই মেটাতে পারি।
সমগ্র অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন জিব্রিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল ড. সাবা ইসমাইল নাদভি।