ইতিহাস লিখতে নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি দরকার। কিন্তু আওরঙ্গজেব সম্পর্কে একপেশে বা মনগড়া ইতিহাস লিখেছেন একশ্রেণির ইতিহাসবিদ। আর সেই ইতিহাস পড়ে এই মুঘল সম্রাট সম্পর্কে নানা বিরূপ ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গেছে। সেই ধারণা আমূল বদলে দেয় ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ অড্রে ট্রুস্কের আওরঙ্গজেবকে নিয়ে রচিত গ্রন্থটি, যা নতুন করে চেনায় পরধর্মসহিষ্ণু এক সম্রাটকে। লিখছেন আমিনুল ইসলাম আজ প্রথম কিস্তি
ইতিহাসের মিথ্যা কথন শুধু যে ইতিহাসের উদ্দেশ্যকেই খাটো করে তা নয়, বিপন্ন হয় দেশের বহুত্ববাদী আদর্শও। ইতিহাস বিকৃত হলে মাশুল গুণতে হয় জনগণকেই। অন্ধবিশ্বাস আর আবেগ দিয়ে ইতিহাস হয় না। তা যদি হয়, তাহলে সেটা হতে পারে উপন্যাস— ইতিহাস নয়। ইতিহাসের বহু অতিকথা ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয় যুগের সঙ্গে সঙ্গে গবেষণার বিকাশ ও নানা অজানা তথ্য উন্মোচনের মধ্য দিয়ে। বহু অভিনব মাত্রা সংযোজিত হয়ে আলোকিত হয় অন্ধকারময় ইতিহাস। মধ্যযুগের ভারত ইতিহাসের ক্ষেত্রে এমনটাই যেন বেশি ঘটেছে। গবেষণালব্ধ ধর্মনিরপেক্ষ ইতিহাসচর্চা উচ্চতর শ্রেণির পাঠ্যসূচির বাইরে অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায় সর্বজনপাঠ্য ইতিহাস গ্রন্থের ব্যাপক পাঠক এখনও আগেকার ভুলই আওড়ে চলেছেন। আর পক্ষপাতদুষ্ট ইতিহাসের এই পাঠই মৌলবাদী রাজনীতিবিদদের জন্যে উর্বর ক্ষেত্র তৈরি রাখছে, যেখানে তাঁরা হিংসা-বিদ্বেষের বীজ নিয়ত বুনে চলেছেন। যদি এই ধ্বজাধারীরা সংঘ-পরিবার পোষিত হন— তাহলে তো আর কথাই নেই।
স্বাধীনতার পর থেকেই তাঁরা সারা দেশে ‘ভারত ধারণা’কে পুনর্র্নির্মাণ করে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি হতে একে নতুন রূপ দেওয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন।
মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব এখন তাঁদের অন্যতম টার্গেট। এমনকি যাঁরা সরাসরি তথাকথিত হিন্দুত্ববাদী নন— এমন ঐতিহাসিকরাও আওরঙ্গজেবকে এই বলে চিহ্নিত করেন যে, তিনি বহু হিন্দু ও জৈন মন্দির ভাঙতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন অসহিষ্ণু ও ক্ষমতালোভী। ইসলাম রক্ষার নামে নিজ ভ্রাতা দারাশিকোহ-সহ অন্য ভাইদের হত্যা করেন। বাবাকে বন্দি করেন। মুসলিম নন, এমন বিধর্মীদের উপর তিনি জিজিয়া কর বাধ্যতামূলক বসিয়েছিলেন। শিখগুরু তেগবাহাদুরকে খুন করিয়েছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। এভাবে পরিপ্রেক্ষিত বাদ দিয়ে সংঘ সমর্থকরা ইতিহাসের চরিত্রের দ্বান্দ্বিক মূল্যায়ন অস্বীকার করে আওরঙ্গজেব সম্পর্কে একপেশে ইতিহাস লিখছে। কিন্তু মনগড়া ইতিহাস লিখলে তো আর হয় না। নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি দরকার। দেখতে হবে ঐতিহাসিক চরিত্রের মূল্য নিরূপণে যেন ধর্মীয় বৈষম্যের অনুপ্রবেশ না ঘটে। দেখতে হবে ঐতিহাসিকেরা যেসব তথ্য আমদানি করছেন সেগুলি সত্য বা বিজ্ঞানসম্মত, সর্বোপরি পক্ষপাতশূন্য কিনা।
এভাবে বহু অন্ধকারাচ্ছন্ন অধ্যায় ও ঘটনার উপর নিয়ত গবেষকরা আলো ফেলছেন। বেরিয়ে আসছে বহু অজানা তথ্য। পুরনো চিন্তা তাতে নড়ে যাচ্ছে। মেনে নিতে হচ্ছে পছন্দ হচ্ছে না এমন বহু তথ্যই। এভাবেই সংশোধনের মাধ্যমে ইতিহাসের বিশুদ্ধতার ধারা যে বজায় রয়েছে তার সাম্প্রতিক উদাহরণ হল— নিউজার্সির রুটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসের অধ্যাপক অড্রে ট্রুস্কের ‘আওরঙ্গজেবn দ্য ম্যান অ্যান্ড দ্য মিথ’ নামক গ্রন্থটি। এখানে সম্রাট আওরঙ্গজেবকে নিয়ে নতুন করে জানতে-বুঝতে প্রয়াস চালিয়েছেন ঐতিহাসিক অড্রে ট্রুস্কে।
সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে মুঘল সাম্রাজ্য সবচেয়ে বেশি প্রায় ৪০ লক্ষ বর্গ কিমি জুড়ে বিস্তৃত ছিল, ছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ অর্থনীতি ও উৎপাদনশীল অঞ্চলও। পাঁচ দশকের শাসনামলে সাম্রাজ্যের ১৬ কোটি বাসিন্দার জীবনে সুখ-শান্তি ও সুশাসন নিশ্চিত করতে ক্ষমতাধর এই সম্রাট যে অনাড়ম্বর ও সাদাসিধে জীবন-যাপন করেছেন, তা আজও বিশ্বের শাসকগোষ্ঠীর জন্য অনুকরণীয়।
দুঃখের বিষয়, এই সম্রাটকে ইতিহাসে তাঁর প্রাপ্য সম্মান দেওয়া হয়নি। তিনি ভারত ইতিহাসে সাধারণভাবে বিকৃত ও নিন্দিত। এক্ষেত্রে দেশি-বিদেশি গবেষকরা যেভাবে গলদঘর্ম হয়েছেন তার তুলনায় কম আলোচিত হয়েছে তাঁর সময়ের নানা বৌদ্ধিকচর্চা ও পরধর্মসহিষ্ণুতার মতো উজ্জ্বল দিকগুলি। আওরঙ্গজেবকে মহৎ দেখাবার জন্য বলছি না। ত্রুটি-বিচ্যুতি, অপরাধগুলিকে মান্যতা দিয়ে একথা বলা যায়— তাঁর কাজ সম্পর্কে খোলামনে পর্যালোচনা ও সমালোচনা করা উচিত। আওরঙ্গজেব চরিত্রের অনেক অজানা দিক এখন বেশ কিছু ঐতিহাসিক তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন ও করছেন।
ব্
রিটিশ ঐতিহাসিক উইলিয়াম ডালরিম্পল ২০১২ সালে প্রকাশিত ‘প্রিন্সেস অ্যান্ড পেইন্টার ইন মুঘল দিল্লি ১৭০৭-১৮৫৭’ গ্রন্থের ভূমিকায় (গ্রন্থটি তিনি যূথিকা শর্মার সঙ্গে সহ-সম্পাদনা করেছেন) লিখেছেন: ‘Aurangzeb’s rule was less tyranical than previously thought. He was a pragmatic ruler who frequently patronised Hindu Institution.’ তাঁর মতে, আওরঙ্গজেবকে নতুনভাবে পড়া উচিত। তাঁর আমলে একদিকে যেমন কোনও দাঙ্গার ঘটনা ঘটেনি তেমনি তিনি তাঁর সৈন্যদলকে তরবারির জোরে ধর্মান্তরণ করার নির্দেশ দেননি। রাজমোহন গান্ধি তাঁর ‘পাঞ্জাবn এ হিস্টরি ফ্রম আওরঙ্গজেব টু মাউন্টব্যাটেন’ গ্রন্থে আওরঙ্গজেবের রাজনৈতিক বিচক্ষণতার প্রশংসা করেছেন। বলেছেন, আজকের আধুনিক অর্থে আওরঙ্গজেবকে নিরপেক্ষ বলা যায় না। সেই অর্থে কিন্তু সমান কঠিন অন্য সম্রাটদের বিশেষ করে সম্রাট আকবরকেও নিরপেক্ষ বলা— তাঁরা যতটা অসাম্প্রদায়িক ছিলেন, আওরঙ্গজেবও ততটাই।
ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার আওরঙ্গজেবকে নিয়ে অসামান্য সব গ্রন্থ লিখেছেন। পরিতাপের বিষয় হল, ঔপনিবেশিক উপমহাদেশের ইতিহাসে সরাসরিভাবে তাঁকে ঘূর্ণিত ও বিতর্কিত চরিত্র হিসেবে তুলে ধরার অন্যতম প্রতিভূ হয়ে ওঠেন স্বয়ং যদুনাথ সরকারই। তিনি স্বজ্ঞানেই তথ্যকে বিকৃত করার মাধ্যমে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আওরঙ্গজেবের চরিত্রকে হীনভাবে অঙ্কন করেছেন। এতদিন ধরে আওরঙ্গজেবকে নিয়ে তিনিই শেষকথা বলে এসেছেন। এছাড়া ইলিয়ট ও ডওসনের ‘হিস্টরি অফ ইন্ডিয়া অ্যাজ টোল্ড বাই ইটস ওন হিস্টরিয়ানস’, শ্রীরাম শর্মার ‘দ্য রিলিজিয়াস পলিসি অফ দ্য মুঘল এম্পাররস’, এ এল শ্রীবাস্তবের ‘দ্য মুঘল এম্পায়ার’ প্রভৃতি গ্রন্থে আওরঙ্গজেবের ধর্মনীতিতে হিন্দু বিদ্বেষকে বিশদভাবে দেখাবার চেষ্টা করা হয়েছে। ইউরোপীয় পর্যটক ও লেখকরা আরবি-ফারসি গ্রন্থের বক্তব্য ইংরেজিতে অনুবাদ করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃত অর্থ প্রকাশ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। ফলে তাঁদের বিবরণগুলি ও গ্রন্থগুলি খুঁটিয়ে ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ হতে বিশ্লেষণ না করে গৃহীত হওয়ায় আওরঙ্গজেব সম্পর্কে বিতর্ক আরও জোরালো হয়েছে। তাছাড়া যদুনাথ সরকার ও শ্রীরাম শর্মা প্রমুখের মতো প্রখ্যাত ঐতিহাসিকরাও আকর উপাদানগুলি যথাযথ ব্যবহার না করায় চরম ঐতিহাসিক সত্য বহু ক্ষেত্রে বিকৃত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। দেখা যাচ্ছে, যদুনাথ সরকার প্রমুখ ঐতিহাসিকরা যেভাবে আওরঙ্গজেবকে উপস্থাপন করেছেন, শাসক ও মানুষ হিসেবে তিনি তার থেকে ছিলেন অনেকটাই আলাদা।
যদুনাথ সরকার প্রমুখ ঐতিহাসিকদের প্রতি যথোচিত সম্মান জানিয়ে বলা যায় যে, তাঁদের চিত্রিত আওরঙ্গজেব বেশ সাম্প্রদায়িক রঙে রাঙানো এবং বহু স্থানে বিভ্রান্তি চোখে পড়ার মতো। শিবলী নোমানী, আতাহার আলি, ইকতিদার আলম খান, ইরফান হাবিব, সতীশচন্দ্র, হরবংশ মুখিয়া, রেখা যোশী, বি এন পাণ্ডে, জ্ঞানচন্দ্র, আর এম ইটন প্রমুখের উত্তরসূরি হিসেবে ঐতিহাসিক অড্রে ট্রুস্কে তাঁর ‘আওরঙ্গজেব’-এ অপূর্ব তাত্ত্বিকতায় অকপটভাবে যদুনাথ সরকার প্রমুখ ঐতিহাসিকদের মিথ্যাচারিতার অকাট্য জবাব দিয়েছেন। ঐতিহাসিক দীপেশ চক্রবর্তীর মতো ঐতিহাসিকও আওরঙ্গজেব-বিরোধিতার মতো অস্বস্তিকর বিষয়টি তাঁর ‘দ্য কলিং অফ হিস্টরি: স্যার যদুনাথ সরকার অ্যান্ড হিজ এম্পায়ার অফ ট্রুথ’ গ্রন্থে সুচতুরভাবে এড়িয়ে গেছেন। অথচ আওরঙ্গজেবের সময়েই সম্রাট আকবরের ‘সুল-ই-কুল’ নীতির বাস্তব প্রয়োগের প্রকৃষ্ট উদাহরণ লক্ষ্য করা যায়।
আওরঙ্গজেবের শাসনকাল যে ধর্মান্ধতায় আচ্ছন্ন ছিল না, বরং বিদ্যাচর্চায় বিপুল উৎসাহ দান করত, তার কৌতূহলোদ্দীপক নানা উদাহরণ সব বিধৃত হয়েছে চন্দ্রভান ব্রাহ্মণ বিরচিত ইতিহাসে। চন্দ্রভান ছিলেন মুঘল দরবারে কর্মরত অন্যতম আমলা বা রাজকর্মচারী। তিনি ফারসিতে লিখেছেন—দরবারি স্মৃতিকথা ‘চাহার চমন,’ ‘চার বাগান,’ বিভিন্ন নামে লেখা বহু ব্যক্তিগত চিঠিপত্র সংকলন এবং ‘মুনসাৎ-ই-ব্রাহ্মণ’ ইত্যাদি গ্রন্থ। চন্দ্রভানের উপলব্ধি— প্রশাসনিক সাফল্য কেবল সামরিক কর্তৃত্বের উপর নির্ভর করে না, তার সঙ্গে থাকে প্রশাসনিক দক্ষতা, গভীর সংবেদনশীলতা আর সর্বোপরি নিঃস্বার্থভাবে জনহিতৈষী কাজ করার মানসিকতা ও কর্ম বিষয়ে তদারকি। —অসাধারণ মুন্সিয়ানায় অড্রে ট্রুস্কে তাঁর ‘আওরঙ্গজেব’ গ্রন্থে মূলত ‘চন্দ্রভানের উপলব্ধি’গুলি নানা দুষ্প্রাপ্য তথ্য-উপাত্ত দিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন। বিশ্লেষণ করেছেন শাসক ও তাঁর কর্মচারীর পারস্পরিক সম্পর্ককেও, যে সম্পর্কের উপর নির্ভর করে সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব।
কর্মচারীদের প্রতি পক্ষপাতশূন্য মনোভাব আওরঙ্গজেবের বহু পাণ্ডুলিপিতে বিধৃত হয়েছে, যা খুবই তাৎপর্যবাহী। একদা কোনও এক ব্যক্তি আওরঙ্গজেবকে এই মর্মে দরখাস্ত করে যে, হিন্দু রাজা ও অন্যান্যরা যারা সরকারি কাজে নিযুক্ত রয়েছে তাদের স্থানে মুসলিম কর্মচারী নিয়োগ করা হোক। প্রত্যুত্তরে আওরঙ্গজেব বললেন— ‘এইসব জাগতিক ব্যাপারের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক কী? …তোমার জন্য তোমার ধর্ম, আমার জন্য আমার ধর্ম (কুরআন)। যদি (তোমাদের কথা মতো) এই নিয়ম চালু করা হয়, তাহলে আমায় তো সকল (হিন্দু) রাজা ও তাদের অনুগামীদের ধ্বংস করে ফেলতে হবে।’’
আর এক চিঠিতে তিনি ঘোষণা করেন, ‘কারও ধর্ম নিয়ে আমাদের কি চিন্তা থাকতে পারে? যিশুকে তাঁর ধর্ম অনুসরণ করতে দাও, আর মোজেসকে তাঁর নিজের ধর্ম।’’ আসলে আবুল ফজলের সার্বভৌমিকতা তত্ত্বের মূলনীতিগুলি যে মুঘল রাষ্ট্রনীতিতে বিশেষ করে আওরঙ্গজেবের রাষ্ট্রনীতিতেও স্থায়ীভাবে স্থান পেয়েছিল তা আরও প্রমাণিত হয় যদুনাথ সরকারের ‘আহকাম-ই-আলমগিরি’ গ্রন্থে সংরক্ষিত আওরঙ্গজেবের এমন সব বিভিন্ন উক্তি থেকে।
উল্লেখ্য যে, যদুনাথ সরকারের মতো জাতীয় ঐতিহাসিক আওরঙ্গজেবের ধর্মনীতির পক্ষপাতদুষ্ট ব্যাখ্যা দেওয়ায় তাঁর আলোচনায় মূল ইতিহাসের অন্যান্য দিক যেমন— অর্থনৈতিক সংকট, জায়গীরদারি সংকট, মনসবদারি সংকট, কৃষি সংকট, অভিজাতদের দল ও রাজনীতি প্রভৃতি বিষয়গুলি উপেক্ষিত হয়েছে।
স্বাধীনতার প্রাক্কালে পরাধীন ভারতবর্ষে ১৯৪০-এ শ্রীরাম শর্মা ব্রিটিশ ঐতিহাসিকদের অনুসরণে তাঁর বিখ্যাত ‘দ্য রিলিজিয়াস পলিসি অফ দ্য মুঘল এম্পাররস’ গ্রন্থটি লেখেন। তখনও পর্যন্ত এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে গবেষণাধর্মী তথ্যনির্ভর বই একটিও ছিল না। সঙ্গত কারণেই শ্রী শর্মার কাজটি বহু বছর ধরে বিশেষ ক্ষেত্রে আদৃত হয়েছে। বর্তমানে মধ্যযুগের ইতিহাসের প্রখ্যাত গবেষক মুহাম্মদ আতাহার আলি গ্রন্থটি সমীক্ষা করে বলেছেন, বইটির অন্যান্য অংশের মতো আওরঙ্গজেব সম্পর্কে আলোচনার শেষে সংযোজিত টীকাগুলিতেও বড় রকমের ভুল ও অসঙ্গতি থেকে গেছে।
শ্রীরাম শর্মা হিন্দু প্রজাদের সঙ্গে আওরঙ্গজেবের ব্যবহারের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে হিন্দু মন্দির ধ্বংসের কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু আধুনিক ঐতিহাসিকরা আওরঙ্গজেবের ধর্মনীতিকে এক নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁদের মতে, আওরঙ্গজেবের মন্দির ধ্বংসের পিছনে ধর্মের ভূমিকা ছিল গৌণ। তাঁর মন্দির ধ্বংসের কাহিনি কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনার উপর গড়ে উঠেছে বলে মনে করেন পার্সিভ্যাল স্পীয়ার ও সতীশচন্দ্র। ঐতিহাসিক অড্রে ট্রুস্কের অভিমতও তাই। এটা ভাবা ভুল যে, মন্দির ধ্বংস করার জন্য কোনও সাধারণ সরকারি আদেশ বা ফরমান জারি করা হয়েছিল। বিখ্যাত বেনারস ফরমানে তিনি হিন্দুদের ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার সুনিশ্চিত করেন। তবে অপ্রিয় কাজ আওরঙ্গজেব করতে বাধ্য হয়েছেন আইন-শৃঙ্খলাগত কারণে, কারও প্রতি বিদ্বেষবশত নয়। অড্রে ট্রুস্কে যথার্থই বলেছেন—.আওরঙ্গজেব হিন্দুদের অপছন্দ করতেন বলে তিনি হিন্দু মন্দির ভেঙেছেন, দাবিটিতে বিন্দুমাত্র সারবত্তা নেই। আওরঙ্গজেবের সময়ে উপমহাদেশজুড়ে কয়েক হাজার হিন্দু মন্দির ছিল, অথচ মাত্র বারো-চৌদ্দটি ধ্বংস হল কেন? কেন বেশি হল না?. আওরঙ্গজেবের শাসনকালে যদি কেউ নির্মোহ ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে নজর দেন তাহলে তিনি দেখতে পাবেন, তিনি যে কয়েকটা মন্দির ধ্বংস করেছেন, তার অনেক বেশি তিনি রক্ষা করেছেন।’পৃষ্ঠা ১০৬-১০৭)। সেকালে মন্দিরগুলি ব্যবহৃত হত রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র রচনার নিরাপদ ঘাঁটি হিসেবে। কোনও রাষ্ট্রনায়কের পক্ষে যা বরদাশ্ত করা সম্ভব নয়। শান্তিভঙ্গের আশঙ্কায় ও বিদ্রোহ দমনের উদ্দেশ্যে সেখানে সেনাবাহিনী পাঠানো হত। ফলে ধর্মস্থান ভঙ্গ হত বা আক্রান্ত হত যুদ্ধের নিয়মেই।
১৬৫৯ থেকে ১৬৯৯-এর মধ্যে আওরঙ্গজেব এলাহাবাদের সোমেশ্বরনাথ মহাদেব মন্দির, উজ্জয়িনীর মহাকালেরশ্বর মন্দির, চিত্রকুটের বালাজি মন্দির, গুয়াহাটির উমানন্দ মন্দির, মহারাষ্ট্রের নানদেড় জেলার মোহনপুরের দত্তাত্রেয় গুরুমন্দির, পুণের গণপতি মন্দির, আহমদাবাদের শত্রুঞ্জয় জৈন মন্দির, কাশীর জঙ্গমবাড়ীর শিব মন্দির, অযোধ্যার দন্তধাবন মন্দির, ভারতের প্রাচীনতম নাগেশ্বর মন্দির, আবু পাহাড়ে অবস্থিত মন্দির, জুনাগড়ের মন্দির (গার্নার), দেরাদুনের গুরুদোয়ারা এবং একাধিক শিখ গুরুদোয়ারা প্রভৃতি ধর্মীয় উপাসনাগার নির্মাণের ক্ষেত্রে ফরমান জারি করে জায়গীর দান করেছিলেন। এভাবে বহু বিখ্যাত ধর্মস্থানে তিনি অর্থও দান করেছেন— কখনও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য, কখনও মন্দিরগুলির নির্মাণ কাজ বা মন্দিরগুলির দুরবস্থা ঘোচানোর জন্য। আর এম ইটনের এক তথ্য হতে জানা যায় যে, আওরঙ্গজেবের আমলে (১৬৫৮-১৭০৭) শুধু বাংলাতেই নির্মিত হয়েছিল ৫০টিরও বেশি ইটের বড় বড় নতুন মন্দির। তপন রায়চৌধুরি এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন যে, হুগলি জেলার তারকেশ্বরের মন্দিরের জমিটা খোদ আওরঙ্গজেবেরই দেওয়া।
নীতিনিষ্ঠ হিসেবে সম্রাট আওরঙ্গজেব ঠিক করে নিয়েছিলেন রাষ্ট্রীয় নির্দেশনায় (নিশান, কীভাবে মন্দির-সহ অমুসলমান ধর্মীয় সম্প্রদায় ও প্রতিষ্ঠানগুলিকে দেখবেন। একটি কৌতূহলোদ্দীপক নিশান বা রাজাদেশ উদয়পুরের নথি থেকে আলোয় এসেছে, যেটি আওরঙ্গজেব মেবারের রাণা রাজসিংহকে পাঠিয়েছিলেন। রাণাকে সহানুভূতির প্রতিশ্রুতি দিয়ে এবং মণ্ডলগড়ের ‘পরগণা’ ইত্যাদির অধিকার পুনরুদ্ধারের স্বীয়û সঙ্কল্প জ্ঞাপন করে আওরঙ্গজেব ঘোষণা করেন— ‘অনুগতরা (অর্থাৎ রাণা) সহস্র রাজকীয় অনুগ্রহের প্রাপক হইয়াছেন।… মনোযোগ এখন ইহাতে নিবেদিত যে, বিভিন্ন সম্প্রদায় ও পৃথক ধর্মসমূহ শান্তির জগতে বাস করিবে, সমৃদ্ধির দিনযাপন করিবে এবং কেহই অপরের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিবে না। গগনচুম্বী-গৌরবের অধিকারী এই গোষ্ঠীর (নৃপতিকুল) যে-কেহই পরমত অসহিষ্ণুতার আশ্রয় লহিয়াছেন, বৃহৎ সংখ্যক জনগণের বিরোধ-সংঘাত-ক্ষতির কারণ হইয়াছেন, যাঁহারা বাস্তবিকই ঈশ্বরের নিকট হইতে প্রাপ্ত কর্মভার— প্রকৃতপক্ষে তিনি (সেইরূপ নৃপতি) ইহার দ্বারা ঈশ্বরের সমৃদ্ধশালী সৃষ্টি বিনষ্ট এবং ঈশ্বরের গঠন-বিন্যাসের ভিত্তি ধ্বংস করিতে প্রয়াসী হইয়াছেন, ইহা সেইরূপ অভ্যাস যাহা প্রত্যাখ্যাত ও দূরীভূত হইবার যোগ্য। ঈশ্বরের সম্মতি সাপেক্ষে, যখন সত্য স্বতঃস্ফূর্ত হইবে এবং আন্তরিক অনুগতদের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হইবে (অর্থাৎ আওরঙ্গজেব সিংহাসন লাভ করলে), ভক্তিমানের নিকট শ্রদ্ধেয় মদীয় পূর্বপুরুষকুল দ্বারা অনুসৃত সম্মতি প্রথা ও প্রতিষ্ঠিত বিধিসমূহ চতুষ্কোণ জন-অধ্যুষিত পৃথিবীর উপর ঔজ্জ্বল্য পাত করিবে।’’
অর্থাৎ ফরমানে আওরঙ্গজেব বলেন, বিভিন্ন ধর্মের মানুষেরা শান্তির ছায়ায় বাস করুক, তারা স্বচ্ছলতায় জীবন-যাপন করুক, কেউ যেন কারোর কাজকর্মে ব্যাঘাত সৃষ্টি না করে। আমরা যদি ফরমানটার মূল ভাবনাটা পড়ার চেষ্টা করি তাহলে দেখব, আওরঙ্গজেব বলার চেষ্টা করেছেন, সম্রাট হিসেবে তিনি নানান ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে শান্তি বজায় রাখার কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত। আর সম্রাট যে পূর্বসূরি অনুসৃত রাষ্ট্রনীতি পরিবর্তন করার ইচ্ছা পোষণ করেন না, এটা সেই অঙ্গীকারই। একজন মানুষ যিনি সেই সময়ে ধর্মীয় রণহুংকার দিচ্ছেন, তিনি কি এরূপ ঝংকৃত স্বরে পরমত অসহিষ্ণুতা বা ধর্মীয় পক্ষপাতের প্রচেষ্টাকে ভর্ৎসনা করবেন? এই ঘোষণাকর্মে আওরঙ্গজেব আন্তরিক ছিলেন কিনা— তা বিবেচ্য নয়। তাৎপর্যপূর্ণ হল, তিনি ধর্মীয় বিতর্ক তীব্র করার পরিবর্তে নিজেকে সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রনীতিক হিসেবে তা এড়াতে উদ্গ্রীব ছিলেন।