পুবের কলম ওয়েবডেস্কঃ একজন মুসলিম যিনি সাংবিধানিক পদে কাজ করে এসেছেন, তাঁর দেশভক্তিকে কি সন্দেহের চোখে দেখা হবে – শুধুমাত্র সে মুসলিম বলে? তাহলে বর্তমান ভারতে প্রধানমন্ত্রীর শ্লোগান ‘সব কা সাথ, সব কা বিকাশ, সব কা বিশ্বাস’-এর ব্যাখ্যা কী ভাবে করা হবে? প্রশ্ন তুললেন শেখ সদর নইম
গণতান্ত্রিক রাজনীতি প্রতিযোগিতামূলক হতেই পারে। কখনও কখনও এই রাজনীতি তিক্তও হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু ভারতের মতো পরিপক্ক গণতন্ত্রে রাজনীতিতে পারস্পরিক শ্রদ্ধা বজায় রখা একান্ত জরুরি। বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশে রাজনীতির স্তর সভ্যসমাজের নির্দিষ্ট মাপকাঠির নিরিখে এতটা নিচে নেমে যাওয়া উচিত নয়, যেখানে বিদগ্ধ মানুষের সম্মান কালিমালিপ্ত হয়। প্রাক্তন উপ-রাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারির বিরুদ্ধে যেভাবে বিজেপি মুখপাত্র গৌরব ভাটিয়া সম্প্রতি একটি নিকৃষ্ট অভিযোগ এনেছেন- তাতে মনে হওয়া স্বাভাবিক আমাদের রাজনীতির স্তর সভ্যতার যে, কোনও মাপকাঠির নিচে নেমে গেছে।
বিজেপি হামিদ আনসারির বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে- তিনি পাকিস্তানের এক সাংবাদিক নুসরত মির্জাকে ভারতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ২০১০ সালে সন্ত্রাসবাদ,সংক্রান্ত এক সম্মেলনে আনসারির পাশে বসেছিলেন নুসরত মির্জা। পরে নুসরত মির্জা দাবি করেন, তিনি সংবেদনশীল কিছু তথ্য পাচার করেন পাকিস্তানের গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই’কে। অর্থাৎ ঠারে ঠারে বিজেপি বোঝাতে চেয়েছে হাদিম আনসারির পরোক্ষ যোগ ছিল আইএসআই-এর সঙ্গে।
যদিও সরাসরি এই অভিযোগ করেনি বিজেপি। কিন্তু হামিদ আনসারির বিরুদ্ধে এই ধরনের পরোক্ষ অভিযোগ কি অবাস্তর নয়? এটি কি হামিদ আনসারির মতো ব্যক্তিত্বের চরিত্র হনন নয়? আনসারি স্বাভাবিক কারণেই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, ‘আমি পাকিস্তানের সাংবাদিক নুসরত মির্জাকে চিনিও না এবং তাঁকে ভারতে আমন্ত্রণও জানাইনি। সন্ত্রাসবাদ-সংক্রান্ত অনুষ্ঠান আমি দিল্লিতে ২০১০ সালের ১১ ডিসেম্বর উদ্বোধন করি। এই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিতদের তালিকা প্রস্তুত করা হয় ভারতের বিদেশমন্ত্রকের তত্ত্বাবধানে।’
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কে এই হামিদ আনসারি যার বিরুদ্ধে এমন নিকৃষ্ট অভিযোগ এনেছে বিজেপি? হামিদ আনসারি হলেন ভারতের অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় নাগরিক। ১৯৬১ সালে তিনি ‘ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিস’ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তাঁর কূটনীতিবিদ হিসেবে কার্যকালে তিনি ভারতের রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করেছেন অস্ট্রেলিয়া, আফগানিস্তান, ইউএই– ইরান এবং সউদি আরবে। তারপর তিনি রাষ্ট্রসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি ছিলেন বহু দিন।
চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করার পর তিনি আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে নিযুক্ত হন। পরে তাঁকে ‘জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশনে’র চেয়ামম্যান পদে নিযুক্ত করা হয়। তারপর হামিদ আনসারি দু’দফায় ভারতের উপরাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হন। তিনি ২০১৭ সাল পর্যন্ত উপরাষ্ট্রপতি, যিনি দু’বার এই পদে নির্বাচিত হয়েছেন। জোট নিরপেক্ষ বৈঠক এবং দিল্লির কমনওয়েলথ বৈঠকে ভারতীয় বিদেশমন্ত্রকের প্রোটোকলের মুখ্য অধিকর্তা হিসেবে তাঁর অবদানের জন্য ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মশ্রী’ উপাধিতে ভূষিত করে ১৯৮৩ সালে।
২০০৬ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-এর দ্বিতীয় রাউন্ড টেবিল কনফারেন্সের মাধ্যমে গঠিত ‘কনিফিডেন্স বিল্ডিংস মেজার্স অ্যাক্রস সেগমেন্টস ইন স্টেট’-এর বিদেশমন্ত্রকের ‘চিফ অফ প্রোটোকল’ হিসেবে আনসারি তাঁর রিপোর্টে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের উপত্যকায় ফিরে যাওয়ার আধিকার নিয়ে জোরালো সওয়াল করেন। তিনি তাঁর রিপোর্টে লেখেন, কাশ্মীরি পণ্ডিতদের তাদের নিজস্ব বাসভূমি ফিরে যাওয়ার অধিকারকে রাষ্ট্রনীতি হিসেবে ঘোষণা করতে হবে। আনসরির পরিবার ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামীদের পরিবার।
তাঁর কাকা ড. এমএ আনসারি ছিলেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি ১৯২৭ সালে। এরকম একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে পাকিস্তানি এজেন্ট হওয়ার অভিযোগ শুধু হাস্যকর নয়, আপত্তিকরও বটে, এই মানুষের জাতির প্রতি নিষ্ঠা এবং কর্তব্য সম্পাদনের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। ভারতের প্রতি সমর্পিত আনসারি সম্পর্কে এই ধরনের অভিযোগের ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে আশঙ্কা জন্মায়, তবে কি তাঁকে আক্রমণের নিশানা করা হচ্ছে শুধুমাত্র তাঁর নামের জন্য।
একজন মুসলিম যিনি সাংবিধানিক পদে কাজ করে এসেছেন, তাঁর দেশভক্তিকে কি সন্দেহের চোখে দেখা হবে-শুধুমাত্র সে মুসলিম বলে! তাহলে বর্তমান ভারতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির শ্লোগান ‘সব কা সাথ, সব কা বিকাশ, সব কা বিশ্বাস’-এর ব্যাখ্যা কী ভাবে করা হবে।
রাজনৈতিক মহলের একাংশ মনে করছেন জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশনের চেয়ারম্যান থাকাকালীন আনসারি ২০০২ সালে গুজরাত সফরে গিয়ে গুজরাতের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে দাঙ্গা নিয়ে অস্তস্তিকর কিছু প্রশ্ন করেছিলেন বলে বিজেপি তাঁকে আক্রমণের নিশানা করেছে।
দ্বিতীয় কারণ হতে পারে পাকিস্তান। বিজেপি তাদের অতি জাতীয়তাবাদ প্রমাণ করতে গিয়ে সামান্য কারণে বা অকারণে অনেককে সেই পাকিস্তানের গুপ্তচর বলে অভিহিত করে থাকে। ২০১৫ সালে বিহার বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে গিয়ে অমিত শাহ প্রকাশ্যেই বলেছিলেন, বিহারে যদি বিরোধী জোট নির্বাচনে জেতে-তাহলে পটকা ফাটানো হবে পাকিস্তানে। কারও’র সামান্যতম পাকিস্তানি যোগ পেলেই তাকে পাকিস্তানি গুপ্তচর বলা হয়।
তার দেশভক্তি নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। ২০১৫ সালে আমাদের প্রধানমন্ত্রী মোদি পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের জন্মদিনে অনির্ধারিত সফরে পাকিস্তানে গিয়েছিলেন। ১৯৯৯ সালে অপর এক প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী বাস নিয়ে লাহোর সফরে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের দেশভক্তি নিয়ে কোনও প্রশ্ন ওঠেনি। কিন্তু একজন বর্ষীয়ান নেতা যদি ছবি তোলেন এবং তার মধ্যে কোনও পাকিস্তানিকে দেখা যায়, তাহলে সেই নেতার দেশভক্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে!
বহুদিন ধরেই রাজনৈতিক বিতর্কের স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে আমাদের দেশে। ২০১৭ সালে গুজরাতের পালামপুরে প্রধানমন্ত্রী মোদি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এবং প্রাক্তন উপরাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারির বিরুদ্ধে তাঁর ভাষণে অভিযোগ করেছিলেন, তাঁরা নাকি পাকিস্তানের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে গুজরাত নির্বাচনে বিজেপি’কে হারাতে চাইছেন। ঘটনাটি ছিল যে, মনিশঙ্কর আইয়ারের বাড়িতে একটি নৈশভোজে আমন্ত্রিত ছিলেন পাকিস্তানের তদানীন্তন হাইকমিশনার এবং পাকিস্তানের প্রাক্তন বিদেশমন্ত্রী। সেখানে উপস্থিত ছিলেন ভারতের এক প্রাক্তন সেনাপ্রধানও।
তাছাড়া সেই নৈশভোজের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কিছু বিখ্যাত সাংবাদিকও। এই অনুষ্ঠানকে আক্রমণ করে মোদি প্রশ্ন তুলেছিলেন, পাকিস্তানি হাইকমিশনারের সঙ্গে গোপন বৈঠকের কারণ কী? যখন গুজরাতে বিধানসভা নির্বাচন হতে চলেছে,সেই সময় কেন গোপন বৈঠক করা হচ্ছে পাকিস্তানের হাইকমিশনারের সঙ্গে? মোদির ইঙ্গিত পরিষ্কার ছিল। তিনি ভারতের এক প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ও প্রাক্তন উপরাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের পরোক্ষ অভিযোগ তুলেছিলেন।
বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রে এই ধরনের রাজনৈতিক বিতর্কের স্তর নিচে নামিয়ে আনার জন্য সব রাজনৈতিক দলই দায়ী। তবে আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক মূল্যবোধ বাঁচিয়ে রাখতে- এই ধরনের নিম্নস্তরের আরোপ ও প্রত্যারোপ বন্ধ হওয়া প্রয়োজন, নচেৎ ভারত একটি ‘ব্যানানা রিপাবলিক’-এ পরিণত হবে।