পুবের কলম ওয়েবডেস্কঃ এক মাসের ব্যবধানে হারিয়েছে প্রাণপ্রিয় মা ও বাবাকে। প্রথমে কিডনি ও ফুসফুসের সমস্যায় চলে গেছে মা। ঘটনার ২২ দিনের ব্যবধানে হাসপাতালের আটতলার কার্নিশ থেকে পড়ে মৃত্যু হয় তার বাবারও। জানা গেছে ভিডিও কলের মাধ্যমে বাবা কে ‘বাবা বাবা’ বলে ডেকেও লাভ হয়নি। বাবা ফিরেই তাকাইনি ছেলের দিকে। এর পরেই সেই বীভৎস, মর্মান্তিক ঘটনার সাক্ষী থাকে গোটা কলকাতা।
স্ত্রী’য়ের মৃত্যু শোক কাটাতে না পেরে ৮ তলার কার্নিশ থেকে ঝাঁপ দেন সুজিত অধিকারী। মাসখানেকের ব্যবধানে বাবা-মা’কে হারানো, ন’বছরের ওই বালক চলতি শিক্ষাবর্ষে এখনও পর্যন্ত এক দিনও স্কুলের ক্লাস করেনি, এমনটাই জানা গেছে সংবাদ সংস্থা সূত্রে।
তবে কি বাবা মা হারনো এই শিশুটির পড়াশোনায় এই খানেই ইতি টানতে হবে! চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রটিকে নিয়ে এমনই উদ্বেগ প্রকাশ করছে স্কুল কর্তৃপক্ষ।
চলতি শিক্ষাবর্ষে এখনও পর্যন্ত এক দিনও স্কুলের ক্লাস করেনি। দেয়নি একটা পরীক্ষাও। পর পর হারিয়েছে দুই অভিভাবককে, তাহলে কি এবার স্কুলছুট হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে?
উল্লেখ্য, ২৫ জুন হঠাৎ করেই মল্লিকবাজারের ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস চত্বরে হঠাৎ শোরগোল পড়ে গিয়েছিল। ওই হাসপাতালের চিকিৎসাধীন এক রোগী সুজিত অধিকারীকে হাসপাতালের আটতলার কার্নিশ থেকে ঝুলতে দেখা যায়। পরে সেখান থেকে পড়ে গিয়ে মৃত্যু হয় তাঁর। দু’ই ঘণ্টার বেশিও সময় অতিক্রম করার পর হয়নি তাঁকে নামিয়ে আনা যায়নি। প্রশাসনের সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। হাসপাতালের আপ্রাণ চেষ্টাতেও বাঁচানো যায়নি সুজিতকে।
মৃত সুজিত অধিকারী ও স্ত্রী রিয়া অধিকারীর ৮/৯ বছরের ও আড়াই বছরের এক পুত্র সন্তান রয়েছে।
পরিবার সূত্রে খবর, সুজিত মৃত্যুর কিছুদিন আগেই মৃত্যু হয়েছিল তাঁর সহধর্মিণী রিয়া অধিকারীর। কিডনির সমস্যা নিয়ে রিয়াকে ভর্তি করানো হয়েছিল উল্টোডাঙার একটি বেসরকারি হাসপাতালে। সেখান থেকে পরে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় খান্নার একটি হাসপাতালে। পড়ে তাঁকে এসএসকেএমে স্থানান্তরিত করার কথা উঠলেও শারীরিক অবস্থার অবনতির জেরে তাঁকে লেকটাউনের এক বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও শেষরক্ষা হয়নি। ৪৭ দিন ধরে একাধিক হাসপাতালে ঘুরেও বাঁচানো যায়নি রিয়াকে।
সদ্য পিতা মাতা হারানো চতুর্থ শ্রেণীর এই ছাত্র সুজিতের ঠাকুরমা শিবানী অধিকারীর কাছে থাকে। বছর আশির ওই বৃদ্ধার কাছেই বড় হয়েছেন ছোটবেলায় বাবা-মাকে হারানো সুজিতও।
সুজিতের ঠাকুমা জানান, রিয়ার অসুখ ধরা পড়ার আগে বাচ্চাদের পড়াশোনার এমন অবস্থা ছিল না। টানা ৪৭ দিন রিয়াকে নিয়ে এই ডাক্তার সেই ডাক্তার করতে গিয়ে পড়াশোনার দিকে খেয়াল দিয়ে উঠতে পারেননি তারা। তৃতীয় শ্রেণির পড়া শেষ করা ছেলেকে পুরনো স্কুল থেকে ছাড়িয়ে লেক টাউনের একটি স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি করেছিল সুজিত।
তার কিছু দিনের মধ্যেই রিয়ার অসুখ ধরা পড়ে। আর তার পর থেকেই শুরু হয় সমস্যা। তারপর তো গরমের ছুটি পড়ে যায়। প্রথমে তারা ভেবেছিল, গরমের ছুটির পরে স্কুলে গিয়ে কথা বলে স্ত্রীর মৃত্যুর কথা জানিয়ে বড় ছেলের বিষয়টা অন্য ভাবে দেখার অনুরোধ জানাবে। তার আগেই তো সব শেষ হয়ে গেল!”
পরিবার সূত্রে খবর, আপাতত পড়াশোনা করার মত পরিস্থিতি ওই বালকের নেই। ছোট ভাইকে দেখাশোনা করছে সে। চতুর্থ শ্রেণীর ওই ছাত্রকে পড়াশোনার কথা জিজ্ঞাসা করা হলে সে বলে, ‘আমার এক কাকু স্কুলে গিয়ে কথা বলেছে, তারা যখন স্কুলে যেতে বলবে তখন আমি যাব! আপাতত আমি ভাইয়ের সঙ্গে খেলাধুলো করব।’
সে সংবাদ সংস্থাকে আরও জানায়, তাঁর ভাই বার বার তাঁদের বাবা-মা কে খোঁজ করে চলেছে! তখন সে একই উত্তর দিচ্ছে বারংবার, ভাই কাঁদিস না! বাবা চকোলেট, কাবাব নিয়ে এক্ষুণি ফিরবে।এই দুটোই ওর প্রিয়।”
হাসপাতালের কার্ণিশ থেকে পড়ে মৃত্যুর ঘটনায় ৯ বছরের ছেলেই এখন আড়াই বছরের ভাইয়ের অভিভাবক।
এই প্রসঙ্গে ওই ছাত্রের স্কুলের প্রধান শিক্ষক বলেন, আমরা খুবই চিন্তিত আছি ওর পড়াশোনা নিয়ে।আমরা কয়েকদিনের মধ্যেই ওর বাড়ি যাব এবং পরিবারের সঙ্গে কথা বলব। পড়াশোনা তো হবেই, তবে ওর মানসিক স্বাস্থ্যের দিকটাও দেখতে হবে।”
রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রীও এই প্রসঙ্গে বলেন, ওই বাচ্চার পড়াশোনার কোনও ক্ষতি আমরা হতে দেব না। আমরা সব দিক থেকে ওকে সাহায্য করবো। এ ভাবে পরিবারের কারও মৃত্যুতে কিছু শেষ হয়ে যেতে পারে না।”