ইনামুল হক, বসিরহাটঃ ঈদের ছুটি মিলেছিল মহিউদ্দিনের। বাড়ি আসার কথা ছিল ৫ জুলাইয়ের পর। কিন্তু তার আগেই ফিরলেন জওয়ান শেখ মহিউদ্দিন। প্রাণহীন দেহ কফিনবন্দী হয়ে সহকর্মী জওয়ানদের কাঁধে চড়ে। সেনার কনভয় থেকে বাড়ির উঠোনে নামানো হল কফিন। মাটিয়ার ঘোড়ারাস উত্তরপাড়া গ্রামের থমথমে পরিবেশ মুহূর্তেই কান্নার রোলে ভরে উঠলো। গ্রামবাসীদের ঢল নামলো মহিউদ্দিনকে শেষ বারের মত দেখতে। তাকে শ্রদ্ধা জানাতে। ভালো ছেলে ছিল মহিউদ্দিন। বাবা মা অনেক আগেই মারা গেছেন। কঠিন সংগ্রাম করে দুই ভাই চাকরি জুটিয়েছিল আর্মিতে। ছোট ভাই মিরাজ উদ্দিন কদিন আগেই বাড়ি ফিরেছে। মহিউদ্দিনের ফেরার কথা ছিল ঈদের আগে। খুশির আগেই শোক সাগরে স্ত্রী রিমানা ইয়াসমিন। দেড় বছরের সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে কোন সান্তনা দেওয়ার ভাষা জানা নেই গ্রামবাসীদের। আত্মীয় পরিজনদের কান্নার আওয়াজে হারিয়ে যাচ্ছিল স্ত্রী রিমানার কথা। তার কথায়, পথ চেয়ে বসে ছিলাম ঈদে বাড়ি ফিরবে।কিন্তু এভাবে ফিরবে ভাবিনি। সেই সাড়ে সাত মাস বয়সে ছেলেটিকে রেখে চলে গিয়েছিল। সবার সন্তান বাবার কোলে উঠবে, আমার সন্তানটি আর বাবার কোলে উঠতে পারবে না। কখনো নিজেকে সান্তনা দিয়ে বলছে, ও শহীদের দরজা পেয়ে গেল। সন্তানকে নিয়ে বাকি জীবন কাটাতে কোন অসুবিধা না হয় সেই আবেদন সরকারের কাছে। ওকে ডাক্তার করতে চেয়েছিল। সেই আশা যাতে পূরণ হয় … বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়ল রিমানা। সহকর্মী ছোটভাই মিরাজ উদ্দিনও দাদার এভাবে ফিরে আসাটা মেনে নিতে পারছেন না। দাদার ছুটি হল, এত তাড়াতাড়ি এভাবেই চিরদিনের জন্য ছুটি হবে তা জানতাম না।
প্রসঙ্গত, মনিপুর ধসে মৃত্যু হয়েছে বসিরহাটের ঘোড়ারাস উত্তরপাড়ার বাসিন্দা সেনা জওয়ান বছর ৩২ এর শেখ মহিউদ্দিন। রবিবার বেলা একটায় মহিউদ্দিন শেখের মৃতদেহ মনিপুর থেকে সেনাবাহিনীর বিশেষ বিমানে দমদম বিমানবন্দরে নামে। সেখানে সেনাবাহিনীর তরফে তার কফিন সামনে রেখে দেওয়া হয় গার্ড অব অনার। তারপর দু’ঘণ্টা পথ পাড়ি দিয়ে নিজের গ্রামে কফিন বন্দি মৃতদেহ এসে পৌঁছালো বিকেেল সাড়ে তিনটেয়। কত ৯ মাস আগে ১৬ আগস্ট থেকে বদলি হয়ে মনিপুরের নালে জেলায় কর্মরত ছিলেন ১০৭ নম্বর ব্যাটেলিয়ান গোর্খা রেজিমেন্টের সদস্য মহিউদ্দিন ও তার ছোট ভাই মিরাজুদ্দিন। ঈদের উৎসবের জন্য দুই ভাই ছুটির আবেদন করেছিল। ছোট ভাই ছুটি পেলেও বড় ভাই ছুটি পায়নি। চলতি মাসে ৫ই জুলাই মঙ্গলবার আসার কথা ছিল বাড়িতে। শেষ কর্মস্থল ছিল মণিপুরের টুপুর স্টেশনের রেল ইয়ারের অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প। সেখানে রেলের কাজ চলছিল। নিরাপত্তার কাজের জন্য ক্যাম্পে হাজির হয়েছিল। হঠাৎই ধসে ২৯ জুন বৃহস্পতিবার রাতে নিখোঁজ হয়ে যায় বহু সেনা জওয়ান। প্রথম দিকেই খোঁজ মেলেনি মহিউদ্দিন এরও। শনিবার দুপুরবেলা বনগাঁ, ব্যারাকপুর, নাগরা কাটা, তিন সেনা জওয়ান এর মৃতদেহ পৌঁছালেও ৪৮ ঘন্টা কেটে যাওয়ার পরে ওই দিন সকাল সাড়ে নটা নাগাদ তার মৃত্যুর খবর বাড়িতে আসে। রবিবার মনিপুর থেকে দুপুর ১ টা নাগাদ আকাশ পথে দমদম বিমানবন্দরে মৃতদেহ নামে। বসিরহাটের বাড়িতে এসে পৌঁছায় বিকে সাড়ে তিনটে নাগাদ। চোখের পানি নিয়ে নিজের ছোট ভাই গোর্খা রেজিমেন্টের ১০৭ নম্বর ব্যাটালিয়নের সদস্য শেখ মিরাজুদ্দিন, তার আত্মীয় পরিজন ও গ্রামবাসীরা মহিউদ্দিন এর শেষকৃত্য সম্পন্ন করতে হাজির ছিলেন। জানাজায় দোয়ায় শরিক হয়ে গ্রামের ছেলে শহীদ বীর সৈনিক শেখ মহিউদ্দিনকে শেষ বিদায় জানালো গোটা গ্রাম।