আসিফ রেজা আনসারী: গত বছর প্রয়াত হন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, সাক্ষরতা আন্দোলনের অগ্রণী পুরুষ এবং সম্প্রীতি প্রচারে অনলস ব্যক্তিত্ব, বিশ্বকোষ পরিষদের প্রধান সংগঠক পার্থ সেনগুপ্ত। তিনি বাংলার সাংস্কৃতিক চেতনা বৃদ্ধি ও আন্তঃধর্ম ও আন্তঃসম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় আমৃত্যু কাজ করে গিয়েছেন। সেই মানুষটিকে স্মরণ করতে স্মরণসভা ও স্মারক বক্তৃতা আয়োজন করেছিল বিশ্বকোশ পরিষদ এবং মা ফাউন্ডেশন। শুক্রবার বিকেলে বিধাননগরের রবীন্দ্র-ওকাকুরা সভাগৃহে সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বহু গুণীজনেরা। সেই সভায় শুধু পার্থ সেনগুপ্ত নয়, উঠে এল বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বহু কথা।
স্মারক বক্তৃতা প্রদান করেন বিশিষ্ট সাংবাদিক ও প্রাক্তন সাংসদ কুণাল ঘোষ। এ দিনের আলোচনা সভায় কুণাল ঘোষ প্রয়াত পার্থ সেনগুপ্ত সম্পর্কে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বলেন, যেসব মানুষ সমাজের কথা ভেবে কাজ করেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম পার্থ সেনগুপ্ত। তিনি যেভাবে সম্প্রীতি ও সৌভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা করেছেন তা মানুষ মনে রাখবে।
এ দিনের স্মারক বক্তৃতা বিষয় ছিল ‘সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা’।
এ সম্পর্কে বলতে গিয়ে কুণাল ঘোষ উল্লেখ করেন, সংবাদপত্র তখনই স্বাধীন ও নিরপেক্ষ হতে পারবে, যখন পাঠকের তরফে সহযোগিতা পাওয়া যাবে। সংবাদমাধ্যম পরিচালনার খরচ ও আয়ের মধ্যে যে বিস্তর ফারাক রয়েছে, সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে গিয়ে সংবাদমাধ্যমকে পরিস্থিতির সঙ্গে ব্যালেন্স করে চলতে হয়। তিনি আরও বলেন, কিছু কিছু মিডিয়া সমাজে বিষ ঢালছে, তাই পাঠককে আগে সচেতন হতে হবে। সংবাদপত্রের বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরির জন্য পাঠক ও দর্শকদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তিনি নবী সা. সম্পর্কে বিজেপি নেতাদের মন্তব্যের নিন্দা জানান।
পাশাপাশি উল্লেখ করেন, বাংলা সব সময় এগিয়ে থাকে। তাই এখানকার রাস্তায় প্রতিবাদ ও অবরোধ করে যেন এখানকার মানুষকে কষ্ট না দেওয়া হয়। ভোটে হারিয়েই বিজেপিকে জব্দ করা উচিৎ বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
এ দিন পার্থ সেনগুপ্ত সম্পর্কে আহমদ হাসান ইমরান বলেন, তাঁর মতো মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। কোনও স্বার্থ ছাড়ায় তিনি সমাজ, সংস্কৃতি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে গিয়েছেন। শুধু ভারতে নয়, বাংলাদেশেও তাঁর পরিচিতি ছিল। তিনি আরও বলেন, আমরা লক্ষ্য করেছি পার্থ সেনগুপ্ত সব সময় নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়াতেন। যেসব মানুষের সামাজিক অবদান থাকা সত্ত্বেও বর্তমান প্রজন্ম ভুলতে বসেছিল, তাঁদের নিয়ে কাজ করেছেন পার্থ সেনগুপ্ত।
এ প্রসঙ্গে তিনি ভাষা আন্দোলনের শহিদ বরকত, নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা, হাজী মহম্মদ মহসীন, মক্কায় প্রথম মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠাকারী বাঙালি নারী সওলাতুননেসা-র নাম উল্লেখ করেন।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সময়ের উপাচার্য, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও রাজ্যের মন্ত্রী স্যার আজিজুল হক সম্পর্কেও আলোকপাত করেন আহমদ হাসান ইমরান। সেই মানুষটিকেই যে বর্তমান প্রজন্ম ভুলতে বসেছে, আর তাঁকে নিয়ে কাজ করেছেন ড. মৃত্যুঞ্জয় পাল। এই সভায় স্যার আজিজুল হক সম্পর্কে পার্থ সেনগুপ্ত পরিকল্পিত একটি পুস্তক প্রকাশ করা হয়। তাই তাঁকে ধন্যবাদ জানান আহমদ হাসান ইমরান।
নবী সা. সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্য করেছেন বিজেপির নেতা-নেত্রী। তাকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে প্রতিবাদ সংগঠিত হচ্ছে। অনেক জায়গায় রাস্তা অবরোধের জন্য মানুষ সমস্যায় পড়ছেন। যেন এমনটা না করা হয় সেই আহ্বান জানান ইমরান। তিনি বলেন, আমরা সেই ঘটনার নিন্দা জানাচ্ছি। তবে মনে রাখতে হবে মানুষের যাতে ক্ষতি না হয়। আমাদের সংযত থাকতে হবে। বুদ্ধিবৃত্তিকভাবেই জবাব দিতে হবে। আমরা কু-কথা বলব না, কোনও অশান্তি সৃষ্টি করব না। আহমদ হাসান ইমরান হাদিস ও কুরআনের কথা উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, আল্লাহ্ ফাসাদ বা অশান্তি সৃষ্টিকারীকে ভালোবাসেন না।
অন্যদিকে পার্থ সেনগুপ্ত সম্পর্কে ড. নুরুস সালাম বলেন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা আমরা মুখে বলি কিন্তু বাস্তবে অনুসরণ করি না, তবে পার্থ সেনগুপ্তই ছিলেন এর ব্যতিক্রমী নজির। তিনি বলেন, আমরা হয়ত পার্থ সেনগুপ্ত হতে পারব না কিন্তু তাঁর সেই আলোকশিখায় নিজেদের জীবনকে আলোকিত করতে পারি।
ড. মুত্যুঞ্জয় পাল স্যার আজিজুল হক সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন। তিনি ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত আজিজুল হক কেন্দ্রীক গবেষণার কথা তুলে ধরেন।
এ দিন মৃত্যুঞ্জয় পালের গবেষণালব্ধ বই ‘ইতিহাসের আলোকে স্যার আজিজুল হক: জীবনকর্ম ও সমকালীন মুসলমান সমাজ’-এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন কুণাল ঘোষ ও বিশিষ্টরা। এছাড়া বক্তব্য রাখেন আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বিশ্বকোষ পরিষদের সভাপতি আমজাদ হোসেন, ড. নুরুস সালাম, অধ্যাপক সাইফুল্লা, নীলাদ্রী সেনগুপ্ত। উপস্থিত ছিলেন প্রয়াত পার্থ সেনগুপ্তের স্ত্রী শিবানী সেনগুপ্ত।