পুবের কলম ওয়েবডেস্ক: বাংলাদেশের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক ও যোগাযোগকে অনেক ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় এবং তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হয়। তাই সাম্প্রতিক সময়ে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ইস্যুতে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আনা এক মার্কিন প্রস্তাবকে আমেরিকার বিদেশনীতির গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন বলে ধরা হচ্ছে। ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের লক্ষ্যে আমেরিকার এই কৌশলগত বদল বর্তমান বাইডেন প্রশাসনের অধীনেই হয়েছে। এর আগে ২০২১ সালের ’গণতন্ত্র সম্মেলন’ থেকে বাংলাদেশকে বাদ দেয় আমেরিকা, ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকার দিবসে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষাদল পাস্ট মোশন ব্যাটালিয়নসহ (র্যাব) বেশকয়েকজন আধিকারিককে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ওয়াশিংটন। এরই পাশাপাশি বাংলাদেশী লেখক ও সমাজকর্মী অভিজিৎ রায়ের খুনিদের সন্ধান দিতে পারলে বা তথ্য দিতে পারলে ৫০ লক্ষ ডলারের পুরস্কার ঘোষণা করেছে মার্কিন সরকার। এজন্যই হয়তো বিভিন্ন কারণে আমেরিকা ও বাংলাদেশের মধ্যে যোগাযোগ নিয়ে হামেশাই চর্চা চলে। বিশেষজ্ঞ ও পরামর্শদাতাদের মধ্যে এ নিয়ে বেশ আগ্রহ রয়েছে। কেনই বা আমেরিকা বাংলাদেশের গণতন্ত্র, আইনের শাসন, ও মানবাধিকার নিয়ে এতটা সরব? অনেকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আমেরিকার সাম্প্রতিক পদক্ষেপকে বাইডেন সরকারের নয়া চাপ প্রয়োগের নীতি হিসাবে দেখছেন। বাংলাদেশী অধ্যাপিকা এবং আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ রুকশানা কিবারিয়া এ বিষয়ে বলেন, ’দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক পরিবর্তন ও উন্নত হচ্ছে। আমেরিকা একটি মহাশক্তি, আর বিষয়গুলি প্রকাশ্যে এসেছে বলেই ফেডারেল সরকার এসব করছে। বেশ কয়েকটি ব্যাপারে বাংলাদেশের সঙ্গে মুখোমুখি হয়েছে মার্কিন সরকার।’ রুকশানা আরও জানান, আমেরিকা যেসকল পদক্ষেপ নিয়েছে তা জরুরি এবং পছন্দগুলি অবশ্যই রাজনৈতিক। অধ্যাপিকার কথায়, ’বাইডেন প্রশাসনের এই নয়া প্রস্তাব দেখে আমরা বলতে পারি এটি পরিবর্তনকারী। বাংলাদেশে ঘটে চলা বেশকিছু ইস্যুতে আমেরিকার অসন্তোষ স্পষ্ট’।
সম্পর্ক আলগা নাকি মার্কিন নীতি পরিবর্তিত?
আমেরিকার সাম্প্রতিক নীতিগুলিকে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের দুর্বলতা হিসাবে ধরা ঠিক নয়। বলা যায়, মার্কিন দৃষ্টিকোণটি বদলেছে। আমেরিকার ইলিনয় অঙ্গরাজ্যের স্টেট কলেজে শাসন এবং রাজনীতি বিষয়ক অধ্যাপক আলি রিয়াজ মনে করেন, বাইডেন সরকার তার বিদেশনীতির মূল ভিত্তি হিসাবে মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলিকে রেখেছে। এই বিদেশনীতি দিয়ে আমেরিকার বুকেও কৌশলগতভাবে নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা সম্ভব হচ্ছে। অধ্যাপক আলির কথায়, ’মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ নিয়ে এগিয়ে চলার কথা বলেছে বাইডেন প্রশাসন। এজন্যই হয়তো বিদেশী ব্যাপারে নাক গলায় তারা। মূলত দুটি ইস্যুতে কাজ করতে চান বাইডেন। প্রথমটি হল, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের পক্ষে সাওয়াল এবং দ্বিতীয়টি হল, এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিজেদের গা বাঁচিয়ে চলা। দ. আলি রিয়াজ বলেন, ’এভাবে তিনি চিনকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে দেশটির উঠতি প্রভাবকে মোকাবিলা করতে চাইছেন। এ কারণেই বিভিন্ন দেশের সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করছে আমেরিকা।’ আলির মতে, ’চিন বাংলাদেশের ওপর এক ধরনের প্রভাব ফেলছে। এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই যে, আমেরিকা এটা নিয়ে ভাবছে। তবে বাংলাদেশকে একঘরে করতে চায় না আমেরিকা। আমি মনে করি বেশকিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে ইঙ্গিত দিচ্ছে মার্কিন সরকার। আসলে তারা বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে চায়।’
চিনকে থামানোই আসল উদ্দেশ্য
মার্কিন থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ’রান্ড কোম্পানির’ এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলের পরিচালক রাফিক দোসানির বিশ্বাস, বাংলাদেশ নিয়ে মার্কিন নীতির পরিবর্তন ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে প্রয়োজনীয়। দোসানির মতে, বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দর ও তার পাশের সিতওয়ে বন্দর অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য চিনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এই বিশেষজ্ঞের মতে, চিনকে মোকাবিলায় আমেরিকা বাংলাদেশের প্রতি তাঁর দৃষ্টিকোণ বদলেছে, মার্কিন নীতি বদলের লক্ষ্য এটাই। রাফিকের কথায়, ’বাংলাদেশ এই দুই শক্তির (আমেরিকা ও চিন) মধ্যে একটিকে বেছে নিতে পারবে না। যদিও সমস্যা সমাধানে আমেরিকার বাংলাদেশকে দরকার। এখানেই ধরা খেয়েছে বাংলাদেশ। এটা শুধু বাংলাদেশের বিপর্যয় নয়। গোটা এশিয়াতেই এটা চলছে। আমেরিকার বর্তমান নীতি হল, আমার দিকে এসো বা আমার কাছে আসো।’
ভারতের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরতা দেখতে চায় না আমেরিকা
ভূ-রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দক্ষিণ এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ দেশ ধরা হয় বাংলাদেশকে। গণতন্ত্র ইস্যুতে দেশটিকে নিয়ে নানা আলোচনা চললেও আমেরিকা দীর্ঘকাল নীরব ভূমিকা পালন করেছে। এই ব্যাপারগুলিতে মার্কিন মিত্র দেশ ভারতেরও সাহায্য পেয়েছে বাংলাদেশ। তবে ড. আলি রিয়াজ বাংলাদেশের প্রতি মার্কিন নীতির পরিবর্তনকে, ভারতের প্রতি আমেরিকার নীতির পরিবর্তন হিসেবেও দেখছেন। তিনি বলেন, ’আমি মানি যে, বাংলাদেশ নিয়ে প্রশ্ন ভারতকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে। এটা বাংলাদেশের একার বিষয় নয়। আমার ধারনা, ভারত ও পাকিস্তানের প্রতিবেশী দেশ- যেমন, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও নেপালের জন্য বিদেশনীতি পুনর্বিবেচনা করছে আমেরিকা।’ রাফিক দোসানি বলেন, ’মনে হচ্ছে, ভারতের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরতা কমানোর উদ্দেশ্য রয়েছে আমেরিকার। আমেরিকা চায় না ওই অঞ্চলে ভারত আধিপত্য ও প্রভাব বিস্তার করুক। তাঁর মতে, ’চিনের মোকাবিলায় ভারতের পদক্ষেপে নজর রাখছে আমেরিকা।’