আহমদ আবদুল্লাহ: শুরু হয়েছে লোকসভা নির্বাচন। আর এই ভোটেরই আবহে আশঙ্কা করা হচ্ছিল পশ্চিমবাংলায় সাম্প্রদায়িকতার উত্তেজনা ছড়িয়ে ভোটকে প্রভাবিত করার চেষ্টা হবে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বিদ্বজনরা বার বার সাবধান করেছেন, বাংলার ঐতিহ্যবাহী সম্প্রীতি যেন কোনোভাবে বিঘ্নিত না হয়, তার জন্য নাগরিকদের সচেতন থাকতে হবে। আশঙ্কার পিছনেও কারণ ছিল।
উগ্র গেরুয়াপন্থীদের তরফ থেকে ঘোষণা করা হয়, তাঁরা এই বাংলায় পাঁচ হাজারেরও বেশি রামনবমীর মিছিল করবেন। ধর্মীয় মিছিল যদি শান্তিপূর্ণ এবং ধর্মের বার্তা দেওয়ার জন্য করা হয়, তবে তাকে সব সম্প্রদায়েরই স্বাগত জানানো দরকার। কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতা বলে, দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ, বিহার প্রভৃতি স্থানে এই রামনবমীর মিছিল থেকে উত্তেজনা ছড়িয়েছে এবং মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। ঘরবাড়ি, দোকানপাটে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। গত বছর পশ্চিমবাংলার হাওড়াতেও অস্ত্র-সহ মিছিল হয়েছে এবং সে নিয়ে উত্তেজনা ছড়িয়েছে। এছাড়া উত্তেজনা ছড়িয়েছিল সেইসময় হিন্দিভাষী অধ্যুষিত রিষড়া এবং আরও কয়েকটি জায়গায়।
এবারও কিন্তু পুলিশ প্রশাসনের সতর্কতা সত্ত্বেও হাওড়াতে অস্ত্র-সহ মিছিল হয়েছে। অথচ কলকাতা হাইকোর্ট রায় দিয়েছিল যে, মিছিল করা যাবে। কিন্তু কোথাও অস্ত্র-সহ মিছিল করা যাবে না। সেই নির্দেশ হাওড়াতে লঙ্ঘন করা হয়।
দ্বিতীয় আর একটি ঘটনা ঘটেছে মুর্শিদাবাদে। সেখানকার শক্তিপুর-রেজিনগর এলাকায় রামনবমীর মিছিল নিয়ে তীব্র উত্তেজনা দেখা দেয়। এর কারণ হচ্ছে, সেই দিল্লি, ইউপি মডেলে এখানেও মিছিলকারীরা স্থানীয় মুসলিমদের লক্ষ্য করে প্ররোচণামূলক শ্লোগান ও কুৎসিত গালাগালি করতে থাকে। কিছু সংখ্যালঘু যুবক এর প্রতিবাদ করলে, তাদের সঙ্গে মিছিলকারীদের প্রথমে বচসা ও পরে মারপিট শুরু হয়।
তারপরই পাথর ছোঁড়া ও ইঁটবৃষ্টিতে বেশ কয়েকজন আহত হন। পুলিশ প্রশাসন বলছে, আহতদের বেশিরভাগই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। এলাকার কয়েকজন হি¨ুও অশান্তি থামাতে গিয়ে আহত হয়েছেন। শক্তিপুর থানার ওসিও রামনবমীর মিছিলের জনতার হাতে আহত হন। তিনি এবং কয়েকজন আহত বহরমপুর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখন নির্বাচনী প্রচারে উত্তরবঙ্গ ও মুর্শিদাবাদে রয়েছেন। তিনি সেখান থেকেই পুলিশ ও গোয়েন্দা রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার রায়গঞ্জের জনসভাতে বলেছেন, বাংলায় রামনবমীর উদ্যাপন উপলক্ষে বিজেপি সহিংসতাকে উসকে দিয়েছে। তিনি আরও বলেন, মুর্শিদাবাদ জেলাতে যে সহিংসতা হয়েছে, তা ছিল ‘পূর্ব পরিকল্পিত’ এবং লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে অশান্তি সৃষ্টি করতেই বিজেপি এগুলি করেছে।
পুলিশ জানিয়েছে, মিছিলের কাছেই বুধবার একটি বিস্ফোরণ হয় এবং তাতে একজন মহিলা আহত হন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জোরের সঙ্গে বলেন, পুরো বিষয়টি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও পূর্ব পরিকল্পিত। রামনবমীর মাত্র একদিন আগে মুর্শিদাবাদের অভিজ্ঞ ডিআইজি-কে অপসারণ করা হয়। এর উদ্দেশ্যই ছিল যাতে তারা (অর্থাৎ বিজেপি) সহিংসতা ছড়াতে পারে। তিনি আরও বলেন, বিজেপির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গুন্ডারা জেলার পুলিশদের উপরও হামলা চালায়।
অন্যদিকে বিজেপির বক্তব্য হচ্ছে, রামনবমীর মিছিলে রেজিনগর এলাকাতে পাথর ছোঁড়া হয়। এছাড়া পিটিআই-এর খবরে বলা হয়েছে, রামনবমীর দিন ১৭ এপ্রিল, ২০২৪ রাত্রি ৯টা নাগাদ পূর্ব মেদিনীপুরের এগরার কলেজ মোড়ে একটি মিছিলে পাথর ছোঁড়ার অভিযোগ ওঠে। এই ঘটনায় চারজন আহত হয়। পুলিশ এই ঘটনার জেরে চারজনকে আটক করেছে। পুলিশ লাঠি চালিয়ে উত্তেজিত জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে। বিজেপি প্রার্থী অগ্নিমিত্রা পল রাস্তা বন্ধ করে সমর্থকদের নিয়ে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন। তিনি তাঁর এক্স হ্যান্ডেলে লিখেছেন, রামনবমীর র্যালিতে অংশগ্রহণকারী হিন্দু- ভাই ও বোনেদের এগরাতে ‘জিহাদি’রা আক্রমণ করে। কিন্তু পুলিশ ‘জিহাজিদের’ গ্রেফতার না করে আক্রান্তদের গ্রেফতার করেছে। বিজেপির ‘কার্যকর্তারা’ পুরো রাত ধরে প্রতিবাদ করেছেন।
শুক্রবার মুর্শিদাবাদের হরিহরপাড়ার জনসভা থেকে তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘আপনাদের বলি, পরশুদিন ছোট্ট একটা ঘটনা ঘটিয়েছিল। আমি জায়গাটার নাম বললাম না। গতকাল আবার ঘটিয়েছিল। তাতে ওসি এবং আমার ভাইও আহত। ১৯ জন আহত হয়েছেন।
কেন অস্ত্র নিয়ে মিছিল করবেন আপনারা? কে আপনাদের অধিকার দিয়েছে অস্ত্র নিয়ে মিছিল করার? কে অধিকার দিয়েছে মণিপুরে ২০০ চার্চ পুড়িয়ে দেওয়ার? কে অধিকার দিয়েছে মসজিদে গিয়ে বোমা মারার? কে অধিকার দিয়েছে দলিতদের উপর অত্যাচার করার? কে অধিকার দিয়েছে সংখ্যালঘু দেখলেই তাদের বাড়িতে এনআইএ ঢুকে পড়ার? এরপর তিনি মনে করান সেই প্রচলিত বাক্য। বলেন, ‘যত গর্জে তত বর্ষে না। শূন্য কলসি বড্ড বাজে বেশি’।