পুবের কলম প্রতিবেদক: শনিবার কলকাতার মৌলালির জার কর্পোরেট হোটেলে আয়োজন করা হয়েছিল ‘দোস্তি কি ইফতারি’র। গত ১৫ মার্চ ছিল আন্তর্জাতিক ইসলামোফোবিয়া প্রতিরোধ দিবস। বিশ্বজুড়ে ইসলাম ধর্ম ও ধর্ম-অনুসারীদের যখন ক্রমাগত হেনস্তা ও হেট ক্রাইমের শিকার হতে হচ্ছে, তখন এই দিবস পালন ও ইসলামোফোবিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও সচেতনতা বৃদ্ধি সময়ের দাবি। সমাজ, রাজনীতি, সাহিত্য, চলচ্চিত্র—প্রায় সমস্ত অঙ্গনেই ইসলামোফোবিয়ার চাষ করে চলেছে একশ্রেণির মানুষ। ইউরোপ-আমেরিকার পাশাপাশি ভারতেও ইসলামভীতি ও ঘৃণা-বিদ্বেষের বাতাবরণ তৈরি করা হচ্ছে। এই প্রেক্ষিতে এদিন ইসলামোফোবিয়া-বিরুদ্ধ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে আলোচনা করেন এবং একে মোকাবিলা করার বার্তা দেন উপস্থিত অধ্যাপক, সমাজকর্মী, বুদ্ধিজীবীরা। সিএএ, এনআরসির প্রেক্ষাপটে দেশ ও এই রাজ্যে মুসলিম বিদ্বেষ নিয়ে জোরালো ভাষণ দেন বক্তারা।
প্রফেসর, সরকারি আধিকারিক, বুদ্ধিজীবীদের সংগঠন মাইনোরিটি কাউন্সিল অফ বেঙ্গলের পরিচালনায় এদিনের আলোচনার আয়োজন হয়। সঙ্গে ছিল সামাজিক সংগঠন ‘নো ইয়োর নেবার’। আলোচনার পাশাপাশি এদিনের অনুষ্ঠানে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের বিদ্বজ্জনদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো।
পশ্চিমবঙ্গ মাইনোরিটি কমিশনের চেয়ারম্যান আহমদ হাসান ইমরান, সাংবাদিক শুভজিৎ বাগচী, সেমন্তী ঘোষ, অধ্যাপক রাজ্যেশ্বর সিনহা, ইপ্সিতা হালদার, গবেষক সাবির আহমেদ, লেখক ও সমাজকর্মী বিশ্বেন্দু নন্দ, প্রাক্তন আইএএস সেখ নুরুল হক, প্রফেসর কাজী সুফিউর রহমান, মির রেজাউল করিম, ড. মেহেদি হাসান, দোলন গঙ্গোপাধ্যায়, অল্ট নিউজ-এর কো-ফাউন্ডার প্রতীক সিনহা, মুহাম্মদ নুরুদ্দিন, সাংবাদিক সুমন ভট্টাচার্য, ড. সাইফুল্লা, শহিদুল ইসলাম প্রমুখ এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।
প্রকৃত অর্থে এই সমাবেশ ছিল চাঁদের হাট। বিভিন্ন ক্ষেত্রের প্রতিষ্ঠিত ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা আলোচনা-ইফতারিতে অংশ নিয়ে ইসলামোফোবিয়ার বিরুদ্ধে জোরালো লড়াইয়ের বার্তা দেন। কলকাতার বুকে এ ধরনের আয়োজনকে বিদ্বেষের বিরুদ্ধে এক শক্ত পদক্ষেপ হিসেবে আখ্যা দেওয়া যেতে পারে।
আমাদের সমাজে কীভাবে ইসলামোফোবিয়া বাসা বেঁধেছে এবং তার ফলে মুসলিমরা কী ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছেন, তার এক নির্যাস উঠে এসেছে বক্তাদের বক্তব্যে। অধ্যাপক মেহেদি হাসান বলেন, মিডিয়া, ফিল্ম, সিরিয়াল ইত্যাদির মাধ্যমে ইসলাম-বিরোধী প্রপাগান্ডা চালানো হচ্ছে। পোশাক, খাবার, কালচারকে ভুল ভাবে উপস্থাপন করে বৃহত্তর সমাজের সামনে ভুল বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে বলে তিনি জানান। গবেষক সাবির আহমেদ এ নিয়ে তাঁর উদ্বেগের কথা বলতে গিয়ে জানান, আমরা যাদেরকে উদার মনোভাবাপন্ন বলে ভাবি, যাদের সঙ্গে কাজ করি, তাদের মধ্যেও যে ইসলামোফোবিয়ার বীজ সুপ্ত রয়েছে সেটা মাঝেমাঝেই প্রকাশ হয়ে পড়ে।
ধর্ম না-মানা মানুষরাও মুসলমানদের আচার-অনুষ্ঠান, তাদের পোশাক দেখে নাক সিঁটকায়। কলকাতার তথাকথিত খ্যাতনামা স্কুলে মাঝেমধ্যেই মুসলিম পড়ুয়াদের বলা হয়— তোদের আসল বাড়ি পাকিস্তানে চলে যা। ট্রেন যাত্রাকালীন কেউ ফোনে সালাম দিলে একজন মুসলিম ‘ওয়া আলাইকুম সালাম’ বলতে ভয় পায়, এই বুঝি চিহ্নিত হয়ে গেলাম! বিদ্বেষের শিকার হয়ে এভাবেই মুসলিমদের জীবন কাটে।
বতর্মানে দেশে রাষ্ট্রীয় নজরদারি, মন্দিরমুখী রাজনীতির উল্লেখ করে অধ্যাপক ইপ্সিতা বলেন, খুব সহজেই অনেক কথা বলে দেওয়া যেত আগে। এখন সেটা বলা যায় না। সোশ্যাল মিডিয়ায় কোন কনটেক্সটে সেটাকে ভাইরাল করা হবে কে জানে। একটা নেশন স্টেটকে মন্দিরমুখী করে তোলার জন্য দীর্ঘ প্রচেষ্টা হয়েছে। একদিনে হয়নি এই রামমন্দির। নয়া নাগরিকত্ব আইন প্রসঙ্গে তিনি জানান, দেশে ধর্মীয় মেরুকরণ করার জন্য সিএএ লাগু করা হয়েছে।
আফগানিস্তানের কেউ অত্যাচারিত হলে কিংবা রোহিঙ্গারা অত্যাচারিত হলে তাদের কী হবে? তাদেরকে কি ভারত নাগরিকত্ব দেবে? এই প্রশ্ন তুলে তিনি মন্তব্য করেন-ইসলামোফোবিয়ার এক চূড়ান্ত সময়ের মধ্যে দিয়ে আমরা যাচ্ছি। বঙ্গদেশে বৌদ্ধ ধর্মের ধর্মীয় স্থানকে ধ্বংস করেই কিন্তু গড়ে উঠেছে হিন্দু মন্দির। পদ্মাবত, কেশরি, তানহাজি, কাশ্মীর ফাইলস, কেরালা স্টোরি চলচ্চিত্রগুলির উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, এক ধরনের ইতিহাস চেতনা তৈরি করে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে ফিল্মের মাধ্যমে। এটাকেই দেশের ইতিহাস বলে চালানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গ সংখ্যালঘু কমিশনের চেয়ারম্যান আহমদ হাসান ইমরান এ প্রসঙ্গে জানান, আমাদের যে সহনশীল, সহাবস্থানের ভারতবর্ষ রয়েছে তাকে রক্ষা করতে হবে। দেশে ক্রমাগত মুসলিম বিদ্বেষ বেড়ে চলেছে। কোভিডের সময় দিল্লির নিজামউদ্দিনের তবলিগি জামাতের লোকেদের নিশানা করে যে বিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছিল তার উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেই সময় টিভির নিউজ চ্যানেলগুলিও ঘৃণা ছড়িয়েছিল।
সিএএ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা যদি নাগরিকত্ব দেওয়ার আইন হয় তবে এর মাধ্যমে শ্রীলঙ্কা থেকে আসা তামিল উদ্বাস্তুদের কেন নাগরিকত্ব দিচ্ছে না কেন্দ্র সরকার? এটা যে বিভাজনমূলক আইন তা স্পষ্ট। এভাবে আসলে ইসলামোফোবিয়া ছড়ানো হচ্ছে। এর মোকাবিলা করতে হবে। আমরা ভারতবর্ষকে কিছু আগাছার হাতে ছেড়ে দিতে পারি না। সাংবাদিক, লেখিকা সেমন্তী ঘোষ বলেন, দেশে ইসলামোফোবিয়া যেন ‘ঐতিহ্য’। এর বিরুদ্ধে লড়তে গেলে এ ধরনের অনুষ্ঠান আরও প্রয়োজন।
বিশিষ্ট সাংবাদিক শুভজিৎ বাগচী বলেন, যাদের জন্য সিএএ হল, সেই মতুয়ারাই কেউ এখনও আবেদন করেনি নাগরিকত্বের জন্য। এটা আসলে উত্তর, পশ্চিম ও মধ্য ভারতে ভোট মেরুকরণের জন্য করা হয়েছে। নাগরিকত্ব সমস্যার সমাধান করার জন্যই যদি এটা হয় তবে এত সময় লাগল কেন এটি লাগু করতে। আসলে রামমন্দির নিয়ে আর নির্বাচনী কৌশল কাজ করছে না। তাই এসব করা হচ্ছে। এখন জ্ঞানভাপীর কথা বলা হচ্ছে।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রাজ্যেশ্বর সিনহা বলেন, মুসলিমদের মধ্যে হীনমন্যতার বোধ তৈরি হয়েছে ক্রমাগত বিদ্বেষের কারণে। গোলাম হোসেন শাহ রোড থেকে বাঘাযতীন পর্যন্ত এলাকায় পুরনো জনবিন্যাস দেখলে দেখা যাবে প্রচুর মুসলমানদের বসবাস ছিল এখানে।
এখন তারা সেখানে সহাবস্থান করতে পারছে না। ক্রমশ বারুইপুর, ক্যানিংয়ের দিকে সরে যাচ্ছে। কেউ কেউ আগেই ওপার বাংলায় চলে গেছে। অথচ অনেকগুলো মসজিদ আছে সেখানে। এ থেকেই বোঝা যায় মুসলিমদের কত চাপের মধ্যে রাখা হয়েছে।
লেখক-গবেষক ও কর্পোরেট বিরোধী আন্দোলনের নেতা বিশ্বেন্দু নন্দ বলেন, দীর্ঘ উপনিবেশের উত্তরাধিকার আমরা বহন করে চলেছি। টডের রাজস্থান-সম্পর্কিত বইতে যে মুসলিম-বিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছিল তার প্রভাব কাজ করেছে হিন্দু ভদ্রলোকদের উপর। ইসলামোফোবিয়ার উদাহরণ অবনীন্দ্রনাথের ‘রাজকাহিনি’। সেখানে ‘ভয়ংকর মুসলমান’দের কথা উল্লেখ করা হচ্ছে। এই বইটি প্রতি ভদ্রলোকের বাড়িতে আছে। পুরস্কার ও উপহার হিসেবে দেওয়া হয়। এটা টডের ইসলামোফোবিয়ার উপর দাঁড়িয়ে। প্রকৃতপক্ষে মধ্যবিত্তের ইতিহাস ইসলামোফোবিয়ার ইতিহাস। এই কথাটা আমাদের বলতেই হবে।
ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং পোর্টাল অল্ট নিউজের সহ-প্রতিষ্ঠাতা প্রতীক সিনহা বলেন, মুসলিমদেরকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সবসময় ‘ভিলেন’ বানানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রপাগান্ডা ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে যে মুসলিমরা শিশুর রক্ত খাচ্ছে রমযান মাসে। আর সেটা মিডিয়াতে আসছে। এর বিরুদ্ধে লড়তে গেলে নিজেদের মিডিয়া থাকা জরুরি বলে মন্তব্য করেন তিনি।