সেখ কুতুবউদ্দিনঃ ইন্তেকাল করলেন মুর্শিদাবাদ জেলার ভগবানগোলা বিধানসভা কেন্দ্রের বিধায়ক ইদ্রিশ আলি (৭৩)। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। শীতকালীন অধিবেশনের পর থেকেই অসুস্থ ছিলেন তিনি। হাওড়ার এক বেসরকারি হাসপাতালে দিন কয়েক আগে ভর্তি করা হয় তাঁকে। জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ায় তাঁর শরীরে নানা সমস্যা দেখা দিয়েছিল। দিন কয়েক থেকেই তাঁর অবস্থার আরও অবনতি হতে থাকে।
শেষ বৃহস্পতিবার রাত ২টো ২০ মিনিট নাগাদ ইন্তেকাল করেন ইদ্রিশ আলি। পরিবারে রেখে গেলেন স্ত্রী মনোয়ারা বিবি, দুই কন্যা নাসরিন বেগম ও নার্গিস বেগম এবং এক ছেলে আইনজীবী ইমরান আলি।
শুক্রবার ভোর থেকে বিধায়ক ইদ্রিশ আলির ইন্তেকালের খবর ছড়িয়ে পড়তেই রাজনৈতিক মহল ও তাঁর অনুগামীদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। এ দিন সকালে তাঁর লাশ প্রথমে বাড়িতে আনা হয়। বেলা ১১টা নাগাদ বিধানসভায় তাঁর লাশ নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে শ্রদ্ধা জানান বিধানসভার অধ্যক্ষ বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় সহ বিধায়ক, মন্ত্রী তথা বিরোধী নেতারাও। শ্রদ্ধা জানাতে বিধানসভায় উপস্থিত ছিলেন কলকাতা পুরসভার মেয়র ও মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম, মন্ত্রী সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরি, মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য, মন্ত্রী শশী পাঁজা, মন্ত্রী রথীন ঘোষ, মন্ত্রী তাজমুল হোসেন, পশ্চিমবঙ্গ সং’্যালঘু কমিশনের চেয়ারম্যান আহমদ হাসান ইমরান, রাজ্য ওয়াকফ বোর্ডের চেয়ারম্যান বিধায়ক আবদুল গণি, বিধায়ক দেবাশিস কুমার, তাপস চ্যাটার্জি, অপূর্ব সরকার, ইমানি বিশ্বাস, নৌশাদ সিদ্দিকী, রুকবানুর রহমান, রহিমা মণ্ডল, হুমায়ুন কবীর, প্রাক্তন মন্ত্রী গিয়াসউদ্দিন মোল্লা, সৌমিক হোসেন, অখিল গিরি প্রমু’। এ ছাড়াও ছিলেন ওয়ায়েজুল হক, একেএম ফারহাদ সহ অন্যান্যরা।
রাজনীতির পাশাপাশি বিশিষ্ট আইনজীবী হিসেবেও ইদ্রিশ আলির সুখ্যাতি ছিল। বিধানসভা থেকে তাঁর লাশ নিয়ে যাওয়া হয় কলকাতা হাইকোর্টেও। সেখানে বিচারপতি ও আইনজীবীরা ইদ্রিশ আলিকে শ্রদ্ধা জানান।
উল্লেখ্য, ইদ্রিশ আলির ইন্তেকালের জন্য দিনের প্রথমার্ধে কাজ হলেও বার অ্যাসোসিয়েশনের মিটিংয়ে ‘রেজ্যুলিউশন’ হয়, কাজ স্থগিত রাখা হবে। দিনের দ্বিতীয়ার্থে কলকাতা হাইকোর্টের বিচার প্রক্রিয়া মুলতবি হয়ে যায়।
কলকাতার রিপন লেনের বাড়িতে ইদ্রিশ আলিকে শেষশ্রদ্ধা জানাতে আসেন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি জয় সেনগুপ্ত, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অসীম রায় প্রমুখ। বাড়ি থেকে বিকেল সাড়ে তিনটে নাগাদ গোবরা-১ কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হয় লাশ। সেখানেই দাফনকার্য সম্পন্ন হয়। এ দিন ইদ্রিশ আলির জানাযার নামায পড়ান হাফেজ সেখ সাদরে আলম। জানাযা ও দাফনকার্যে শরিক হন মন্ত্রী সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরি-সহ মুহাম্মদ কামরুজ্জামান, সমাজসেবী কামরুদ্দিন মল্লিক ও তাঁর আত্মীয় পরিজন-সহ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা মানুষজন।
মুর্শিদাবাদের ভগবানগোলা কেন্দ্রের বিধায়ক ছিলেন ইদ্রিশ। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে এই বিধায়ক এক লক্ষেরও বেশি ব্যবধানে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারিয়ে জয়ী হয়েছিলেন। তাঁর ঘনিষ্ঠমহল সূত্রে জানা গিয়েছে, কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার পরেই ইদ্রিশের শরীর ভাঙতে শুরু করে। চলাফেরার ক্ষেত্রেও তাঁর সমস্যা হচ্ছিল। রাজ্যের বাজেট অধিবেশনে এক দিনের জন্যও বিধানসভায় যেতে পারেননি তিনি।
বাম জমানায় সংখ্যালঘুদের অধিকার আদায়ের জন্য বার বার সোচ্চার হয়েছেন। এবং অল ইন্ডিয়া মাইনোরিটি ফোরাম নামে একটি সংগঠন তৈরি করেন। এরপর কিছুদিনের জন্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাকে তৃণমূল সংখ্যলঘু সেলের দায়িত্বও দেন।
প্রসঙ্গত, ইদ্রিশ আলি ১৯৫০ সালের ৩০ ডিসেম্বর হুগলি জেলার গোঘাট থানার ভুরকুন্ডা গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত গৃহস্থ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ইদ্রিশ আলির আব্বা আবদুল আজিজ ছিলেন একজন বেকারি ব্যবসায়ী। মা মাসেমা খাতুন ছিলেন গৃহবধূ। স্কুল জীবনের পাঠ সমাপ্ত করেই পিতার হাত ধরে ইদ্রিশ আলি কলকাতায় এসে ভর্তি হন সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল মিশন কলেজে। পরবর্তীকালে সুরেন্দ্রনাথ আইন কলেজ থেকে তিনি এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন।
কলেজে পড়াকালীন সময় থেকেই কলকাতায় একাধিক সমাজসেবামূলক কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন ইদ্রিশ । আইন কলেজের ছাত্র থাকাকালীন জাতীয় কংগ্রেসের মতাদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। ওই সময় কংগ্রেস নেতা সোমেন মিত্রের সঙ্গে যোগাযোগের সুবাদেই জড়িয়ে পড়েন সক্রিয় রাজনীতিতে। পরবর্তীকালে তিনি তৃণমূল কংগ্রেসে যোগদান করেন। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি মানুষের দাবি-দাওয়া পূরণে হাইকোর্টে একাধিক জনস্বার্থ মামলাও লড়েন মরহুম ইদ্রিশ আলি।
উল্লেখ্য, ২০০৭ সালে ইসলাম ধর্ম অবমাননার জন্য বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত হন তসলিমা নাসরিন। বিতর্কিত লেখিকা তসলিমাকে কলকাতায় আশ্রয় দেওয়ার প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিলেন ইদ্রিশ আলি। এই ঘটনার জেরে তাকে জেলেও যেতে হয় বাম আমলে। অন্যদিকে, কলকাতার একাধিক মসজিদে আযান বন্ধের প্রতিবাদেও শামিল হয়েছিলেন তিনি।
এ ছাড়া সংখ্যালঘু মুসলিমদের পাশাপাশি খ্রিস্টান মিশনারি এবং বৌদ্ধ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গেও তাঁর নিয়মিত যোগাযোগ। মিশনারি অফ চ্যারিটির পাশাপাশি মাদার টেরেসার সঙ্গেও ছিল তার নিবিড় যোগাযোগ। তাঁর মৃত্যুতে অপূরণীয় ক্ষতি হল বলে মনে করছেন বিভিন্ন গণসংগঠন-সহ বিশিষ্টরা।