আহমদ হাসান ইমরান: ইদ্রিশ আলি চলে গেলেন (ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাহি রাজেউন…)। কিন্তু তিনি রেখে গেলেন সংগ্রামী এক ঐতিহ্য। বামফ্রন্টের ৩৪ বছরের রাজত্বকাল ছিল সংখ্যালঘুদের জন্য বঞ্চনা, দারিদ্র্য ও ক্ষমতাহীন করে রাখার সাড়ে তিন দশক। উন্নয়ন বা বিকাশ নয়, তারা ভোট করত এই বলে যে, সিপিএম-এর আমলে দাঙ্গা হয় না। মুসলিমরা নিরাপদ। কিন্তু প্রাণ ও সম্পদের নিরাপত্তা যে প্রত্যেক নাগরিকের প্রাপ্য, তা তারা ভুলে যেত। আর এরই দাক্ষিণ্য দেখিয়ে তারা মুসলিম ভোট হাসিল করত। সেইসময় ইদ্রিশ আলি তাঁর অল ইন্ডিয়া মাইনোরিটি ফোরাম গড়ে সংখ্যালঘু মজলুমদের অধিকার আদায়ে সচেষ্ট ছিলেন। তখন অবশ্য ‘মুসলিম’ কথাটি উচ্চারণ করলেই তাকে ‘সাম্প্রদায়িক’ বলে দেগে দেওয়া হত।
সেই পরিস্থিতিতে খুব বেশি মানুষ বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে কথা বলতে সাহস পেতেন না। মরহুম ইদ্রিশ আলির অল ইন্ডিয়া মাইনোরিটি ফোরাম সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার, নিপীড়ন, বঞ্চনা তুলে ধরার ক্ষেত্রে সরব ছিল। সেইসময় যারা কাজ করতেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন ইদ্রিশ আলি, জনাব হাসানুজ্জামান সাহেব এবং মাসিক ও সাপ্তাহিক কলম পত্রিকা।
ইদ্রিশ আলির সঙ্গে আমার পরিচয় কীভাবে হয়েছিল, তা আমার এখন আর মনে নেই। তবে প্রায় চার দশক ধরে আমি তাঁকে জানি। তিনি মাসিক ও সাপ্তাহিক কলম পত্রিকাকে ভীষণ পছন্দ করতেন। বলতেন, অন্য সংবাদপত্রগুলি তো করবে না। কিন্তু কলম ইনসাফের জন্য কাজ করে। আর মুসলিম জনগোষ্ঠীর সাহিত্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে বিদেশের খবরও তুলে ধরে। তখন ইন্টারনেট ছিল না। তাই তাঁর প্রশ্ন ছিল, আপনারা কীভাবে এই খবরগুলি পান?
সেইসময় আমি দেখেছি ইদ্রিশ আলি তাঁর অল ইন্ডিয়া মাইনোরিটি ফোরামের ব্যানারে প্রতিবাদমুখী বহু কাজ করেছেন। তখন মুসলিমরা ছিল সিপিএম-এর লেঠেল। কংগ্রেস বা বামফ্রন্টেরই অন্য দলের সঙ্গে লড়াইতে বহু লাশ পড়ত। এর বেশিরভাগই হত ২৪ পরগনা, বীরভূম, মুর্শিদাবাদ, মালদহ প্রভৃতি জেলায়। রাজনৈতিক সংঘর্ষে লাশ পড়া মানে তাদের ৯০ শতাংশ হত মুসলিম এবং তপশিলি জাতি। তখন ইদ্রিশ আলি সেইসব ভিক্টিম পরিবারে যেতেন, তাঁদের সান্তনা দিতেন, এফআইআর করার ব্যবস্থা করতেন।
তরুণ তুর্কি বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও বামফ্রন্টের এইসব অত্যাচারের বিরুদ্ধে বহু প্রতিবাদ করেছেন। তিনি লাশ উদ্ধারের জন্য অনুমতি পেতে লালবাজারে গিয়ে বসে থাকতেন। কিংবা সারারাত আক্রান্ত পরিবার যাতে লাশ পায় সেজন্য গ্রামের সেই পরিবারে কাছে গিয়ে রাতভর বসে থাকতেন। ইদ্রিশ আলিও একইভাবে প্রতিবাদ করতেন। একসময় তিনি এই ধরনের গুন্ডামি, খুন-খারাপির প্রতিবাদে দমদম থেকে বাগুইহাটির মধ্যে রাস্তা অবরোধ করেছিলেন। ফলে ইদ্রিশ আলি ছিলেন বামফ্রন্টের চক্ষুশূল।
লিখতে গিয়ে অনেক কথাই মনে পড়ছে। তাই লেখাটি হয়তো একটু খাপছাড়া হবে। অনেকে হয়তো জানেন না, আলিয়া মাদ্রাসার কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবিতে যারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন তাঁদের মধ্যে ইদ্রিশ আলিও ছিলেন। মাদ্রাসার ছাত্ররা এই দাবির পক্ষে অনশন করে। সেইসময় মুকুল রায় এসে ছাত্রদের অনশন ভাঙিয়েছিলেন। বলেছিলেন, দিদি বলেছেন, তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় এলে তাদের দাবি পূরণ করা হবে। যেহেতু ইদ্রিশ আলিও এইসব আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকায় থাকতেন, তাই তাঁকে জধ করার জন্য বামফ্রন্ট সরকার রিপন লেনে অবস্থিত তাঁর বাড়িটি গুঁড়িয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা করে।
রাতের অন্ধকারে সেখানে পুলিশ ও কর্পোরেশনের কর্মীরা এসে হাজির হয় এবং কোনও নোটিশ না দিয়ে ইদ্রিশ আলির কংক্রিটের তিনতলা বাড়িটি ভাঙতে শুরু করে। সে-সময় সোমেন মিত্র পুলিশ মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে ফোন করে তাঁর বাড়ি ভাঙা রুখতে সক্ষম হয়েছিলেন। সেই থেকে সোমেন মিত্রের সঙ্গে ইদ্রিশের সখ্যতা আমরণ অটুট ছিল। মাদ্রাসার আন্দোলনে আরও যাঁরা অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন তাঁরা হলেন বিজয় উপাধ্যায়, কামরুজ্জামান, সাপ্তাহিত কলম পত্রিকা ও তার সম্পাদক আহমদ হাসান ইমরান অর্থাৎ আমি।
ইদ্রিশ আলির সঙ্গে রাজনীতির ছিল ওতপ্রোত সম্পর্ক। বহুদিন আগেই তিনি তাঁর এলাকা হুগলির আরামবাগ থেকে লোকসভা নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন। তারপর দেগঙ্গা, আমডাঙায় নির্বাচনে দাঁড়ান। জিততে না পারলেও ইদ্রিশ ভাই ভালো ভোট পেয়েছিলেন।
এরপর তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পর ২০১৪ সালে বসিরহাট লোকসভা আসনে তাঁকে প্রার্থী করে। বসিরহাট থেকে তিনি লোকসভায় যান। লোকসভাতে ইদ্রিশ আলি সক্রিয় ছিলেন। বিভিন্ন সময় তিনি বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখতেন। তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইদ্রিশ আলি খুবই শ্রদ্ধা ও ভালোবাসতেন। বিরোধীরা কেউ কিছু বললেই ইদ্রিশ বলতেন, যারা এ সব বলছে তাদের জিভ ছিড়ে নেব বা হাত কেটে নেবো। দিদি মানা করতেন, কিন্তু ইদ্রিশ আলিকে রুখবে কে।
তসলিমা নাসরিন তাঁর ‘ক’ বা ‘দ্বিখণ্ডিত’-তে নবী মুহাম্মদ সা. সম্পর্কে যেসব মিথ্যা ও কুৎসামূলক লেখা লিখেছিলেন, কলম পত্রিকায় তা পড়ে ইদ্রিশ আলি খুবই ব্যথিত হন। তিনি তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে কলকাতায় অনুষ্ঠিত বেশকিছু সভা-সমিতিতে অংশ নেন। তসলিমা তখন কলকাতায় পুলিশ গোয়েন্দারের প্রটেকশনে বহাল তবিয়তে রয়েছেন। তারপর রিপন স্ট্রিট থেকে বেশকিছু তরুণ রাস্তায় টায়ার জ্বালিয়ে প্রতিবাদ শুরু করে। দু-একটি যানবাহনে আগুনও দেওয়া হয়। কিন্তু কয়েকটি টিভি চ্যানেলের বর্ণনা অনুসারে কোনও ‘দাঙ্গা’ হয়নি। হিন্দু-মুসলিম কারওই একটি পানের দোকানও পোড়েনি। কিন্তু এই ঘটনাকে টেলিভিশন করে বিরাটভাবে প্রচার করতে থাকে। কলকাতায় কিছু অঞ্চলে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। সেনাও তলব করা হয়। তসলিমা নাসরিন কলকাতা থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে পাড়ি দেন দিল্লির সেফ হাউসে।
কিন্তু ই্দ্রিশ আলিকে বামফ্রন্ট সরকার গ্রেফতার করে জেলে পাঠায়। তাঁর জামিনেরও বিরোধিতা করে পুলিশ। বেশ কিছুদিন পর ইদ্রিশ আলি জামিন পান। এই ঘটনা ইদ্রিশ তসলিমা বিরোধী মহলের কাছে হিরো করে তোলে। আজ পর্যন্ত তসলিমা তাঁর দ্বিতীয় ‘স্বদেশ’ কলকাতায় ফিরতে পারেননি। ইদ্রিশ বলেন, আল্লাহ রসূল সা.-এর বিরুদ্ধে যারা নিন্দা-মন্দ করবে তাদের সম্প্রীতির রাজ্য বাংলায় থাকার অধিকার নেই। ব্যাঙ্কশাল কোর্টে যখন ইদ্রিশ আলিকে কাঠগড়ায় তোলা হয় তখন আমি এবং তাঁর অনেক শুভানুধ্যায়ী আদালতে উপস্থিত থাকতেন। এইসব কথা ইদ্রিশ আলি কখনোই ভোলেননি।
ইদ্রিশ আলি তাঁর আন্দোলন সংগ্রামের পুরস্কারও পেয়েছিলেন। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর তাঁকে বসিরহাট কেন্দ্র থেকে লোকসভার প্রার্থী করা হয়। ইদ্রিশ আলি ব্যাপক ভোটে জয়ী হয়েছিলেন। এরপর উলুবেড়িয়া বিধানসভা আসনে জয়ী হন। পরে দিদি তাঁকে ভগবানগোলায় পাঠালে ইoিশ রেকর্ড সংখ্যক ভোটে বিজয় হাসিল করেন।
ইদ্রিশ ভাই ছিলেন সরল ও নিরহংকারী মানুষ। সাংবাদিকদের সঙ্গে তাঁর ছিল বেশ সখ্যতা। তিনি প্রায়ই বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু, মনীষীদের জন্মদিন পালন প্রভৃতি বিষয় রিপন লেনে তাঁর নিজস্ব চেম্বারে সাংবাদিক সম্মেলন করতেন। তাঁর এসব অবদান কখনোই ভোলার নয়।
তাঁর মৃত্যুর খবর প্রচারিত হওয়ার পর প্রচুর সংখ্যক মানুষ তাঁর জানাযায় অংশ নেওয়ার জন্য কলকাতায় আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর জানাযা ও দাফন কোথায়, কখন ও কীভাবে হবে তা নিয়ে খানিকটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। ফলে অনেক মানুষ তাঁর জানাযায় হাজির হতে পারেননি।
ইদ্রিশ আলির ইন্তেকালে অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি শোকজ্ঞাপন করেছেন।
এঁদের মধ্যে রয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় । বিধানসভায় মরহুম ইদ্রিশ আলির লাশের সামনে শ্রদ্ধা জানান স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় , মন্ত্রী ও মেয়র ফিরহাদ হাকিম, মন্ত্রী ডা. শশী পাঁজা, মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য, মন্ত্রী রথীন ঘোষ, মন্ত্রী সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরি প্রমুখ। বিধানসভায় তাঁর রুহের মাগফিরাতের জন্য হাত তুলে মোনাজাত করেন আহমদ হাসান ইমরান, মাওলানা সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরি, ওয়ায়েজুল হক, একেএম ফারহাদ, রুকবানুর রহমান প্রমুখ।