সুবিদ আবদুল্লাহ্: ‘আমাদের হযরত মুহাম্মদ সা.-এর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হতে হবে। আমাদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হতে হবে। আমাদের নবী সা. সব সময় পড়াশোনাকে উৎসাহ দিতেন। তিনি বাচ্চাদের ভালোবাসতেন। নবী সা.-এর সঙ্গে তাঁর প্রিয় দুই নাতির সম্পর্ক খুব মধুর ছিল। আমাদের উচিৎ তোমাদের সঙ্গে সম্পর্ক মধুর করা’। শুক্রবার কথাগুলি বলেন প্রাক্তন সাংসদ, ‘পুবের কলম’ দৈনিকের সম্পাদক ও রাজ্য সংখ্যালঘু কমিশনের চেয়ারম্যান আহমদ হাসান ইমরান।
এদিন তিনি তারিফা মেমোরিয়াল ইনস্টিটিউটের ছাত্রছাত্রীদের এক অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। পড়ুয়াদের উদ্দেশ্য করে তিনি আরও জানান, যাঁর নামে এই প্রতিষ্ঠান সেই মরহুম তারিফা ম্যামের জন্য তোমরা দোওয়া করবে। তোমরা সকলে ভালো রেজাল্ট করে জনাব আইজুদ্দিন সাহেবের মুখ উজ্জ্বল করবে এই আশা রাখি। তিনি বলেন, পিতামাতা, শিক্ষক ও গুরুজনদের প্রতি তোমাদের শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। তোমরা আগামী ভারতের নাগরিক। মন দিয়ে পড়াশোনা কর। লক্ষ্য স্থির কর, তোমাদের বড় কিছু হতে হবে।
উল্লেখ্য, ইমরান সাহেব মাইনোরিটি কমিশনের কাজে দু’দিনের জন্য নবাবের জেলা মুর্শিদাবাদে এসেছিলেন জেলার সংখ্যালঘুদের হাল-হকিকত জানতে। ঝটিকা সফর হলেও সময় বের করে তিনি ঘুরে যান সমাজসেবী আইজুদ্দিন মণ্ডলের হরিহরপাড়া তারিফা মেমোরিয়াল চ্যারিটেবল ট্রাস্টের অধীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয়। তাঁর সফর সঙ্গী ছিলেন কমিশনের সদস্য শাকিল আহমেদ।
পরিকল্পনা হয় আগের দিনই। বসন্তের বার্তা নিয়ে ঝলমল করছিল বিদায়ী শীতের সকাল। বহরমপুর সার্কিট হাউসের ক্যাণ্টিনের রান্না ঘর থেকে ভেসে আসা লোভনীয় চা-এর গন্ধ উপেক্ষা করেই হাজির হলাম চেয়ারম্যানের ঘরে। কিছুক্ষণ পর হাজির হলেন তারিফা মেমোরিয়াল চ্যারিটেবল ট্রাস্ট-এর প্রতিষ্ঠাতা বহরমপুর পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি আইজুদ্দিন মণ্ডল। আমাদের হরিহরপাড়া সফরের চাকা গড়াতে শুরু করল। আমাদের পৌঁছতে হবে ট্যাংরামারির ‘আশিয়ানা’ এতিমখানা।
যথা সময়ে উপস্থিত হলাম এতিমখানার ক্যাম্পাসে। গাড়ি থেকে নেমে ইমরান সাহেব হাত রাখলেন এক এতিমের মাথায়।
নবী সা.-এর সুন্নত পালন করলেন তিনি। একে একে আরও ২৮ জন এতিম অভ্যর্থনা জানাল শ্রদ্ধেয় মানুষটিকে। উপস্থিত ছিলেন হরিহরপাড়া ব্লকের বিডিও ছেরিং জাম ভুটিয়া, বর্ষীয়ান সমাজকর্মী হাতেমুল ইসলাম ও এতিমখানার শিক্ষক শিক্ষাকর্মীরা। পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি ঘর বিছানা দেখে তিনি অভিভূত। এতিম পড়ুয়াদের তিনি আশীর্বাদ করেন। আইজুদ্দিন সাহেব জানালেন, গত বছর মাধ্যমিকে অভাবনীয় সাফল্যের কথা। দেখলাম, এই সাফল্য দেখে অভিভূত হয়ে ইমরান সাহেবের পা যেন নড়ছে না এতিমখানার ক্যাম্পাস থেকে। তবুও ফিরতে হয়। মন কেমনের একরাশ স্মৃতি নিয়ে আমরা গেলাম তারিফা ইনস্টিটিউট।
আবাসিক ও অনাবাসিক ক্যাম্পাস। অপেক্ষায় ছিল ছাত্রছাত্রীরা। গেট থেকে তারা ফুল ছিটিয়ে স্বাগত জানিয়ে মঞ্চে নিয়ে গেল অতিথিদের। মঞ্চে সকলের সঙ্গে অতিথির পরিচয় করিয়ে দিলেন তারিফা ট্রাস্টের কর্ণধার আইজুদ্দিন সাহেব। এরপর একে একে অতিথিদের বরণ করা হল।
ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশ্যে উপরের কথাগুলি বলার পর আমরা রওয়ানা দিলাম ট্যাংরামারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ২০০ পড়ুয়ার স্কুলটিতে পড়াশোনা ছাড়াও শিশুদের মন ভালো করার সব রকম আয়োজন দেখে অভিভুত হতেই হল। স্কুলের প্রধান শিক্ষক অসীম অধিকারী জানালেন, নির্মল বিদ্যালয় সহ রাজ্যের সেরা বিদ্যালয়ের তকমা পেয়েছে এই বিদ্যালয়টি।
সেখান থেকে আসা হল, হাজী একেখান কলেজে। জানা গেল, হাজী আবদুল কাদের খান জমি দান করেছিলেন কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য। তাঁর নামেই কলেজ। কলেজের পরিচালন কমিটির সভাপতি হাতেমুল ইসলাম চেয়ারম্যানের সঙ্গে অধ্যাপকদের আলাপ করিয়ে দিলেন। কলেজের অধ্যক্ষ ড. গৌতম ঘোষ পড়ুয়াদের হাতে তৈরি হরিহরপাড়ার ঐতিহ্যবাহী বস্ত্র তরতিপুরী গামছায় অতিথি বরণ করেন।
বহরমপুর-হরিহরপাড়া রুটে গজধরপাড়া থেকে ঢিলছোঁড়া দূরত্বে মাদ্রাসা বোর্ডের অধীন ইংলিশ মিডিয়াম মডেল মাদ্রাসা। মাঝপথে জুম্মার জন্য আমাদের থামতেই হল। নামায শেষে যাওয়া হল মডেল মাদ্রাসায়। আগেই খবর ছিল শিক্ষকের অভাবে মডেল মাদ্রাসাটির পঠনপাঠন ব্যাহত হচ্ছে। সে ব্যাপারে খোঁজ নিলেন কমিশনের কর্তারা। প্রধান শিক্ষক ওয়াহেদুজ্জামান ও ডোমা রেনুকা খাতুন মাদ্রাসাটির অচলাবস্থা কাটানোর ব্যাপারে চেয়ারম্যানের সঙ্গে পরামর্শ করেন।
উল্লেখ্য, মডেল মাদ্রাসাটি বহরমপুর ব্লকের অধীন। এদিনের আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন বহরমপুর পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি আইজুদ্দিন মণ্ডলও। তিনি মডেল মাদ্রাসার সমস্যা কাটিয়ে তোলার দায়িত্ব নেবার আবেদন করেন।
দুপুরের আহার শেষে ফেরার অপেক্ষা। সফরের সালতামামি শেষ হল বহরমপুর স্টেশনে। প্রাক্তন বিধায়ক চাঁদ মুহাম্মদ, ইমাম সংগঠনের আবদুর রাজ্জাক ও ডোমা রেনুকা খাতুন উপস্থিত ছিলেন বিদায় জানাতে। এ যেন ‘যেতে নাহি দিতে কয়/তবু যেতে দিতে হয়’ অবস্থা। হাজারদুয়ারী এক্সপ্রেস প্ল্যাটফর্ম ছুঁতেই হুড়মুড়িয়ে পড়লেন যাত্রীরা। ধীর পায়ে উঠে গেলেন ক্ষণিকের অতিথিরা। ট্রেনের ভেতর থেকে ইমরান সাহেব হাত নেড়ে যেন জানাতে চাইলেন, আসি বন্ধু ‘আবার আসিব ফিরে…’।