আহমদ হাসান ইমরান: ভারতবর্ষে এখন সংহতি-র বড় বেশি প্রয়োজন। স্বাধীনতার এতদিন পরে কেন এখন সংহতির প্রয়োজন, তা সারা দুনিয়া জানে। তা ভেঙে বলার আর প্রয়োজন নেই। ইতিমধ্যে বিজেপি ২২ জানুয়ারি অযোধ্যা নিয়ে সারা দেশে বিশেষ কর্মসূচি নিয়েছে। টিভি চ্যানেলগুলির বেশিরভাগ এবং বেশকিছু সংবাদপত্র এমন ধরনের প্রচারণা চালাচ্ছে যে, উত্তর ভারতে খানিকটা হলেও উত্তেজনার সৃষ্টি হচ্ছে।
বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শুধু বাংলাকে নিয়ে ভাবেন না, একজন দেশনেত্রী হিসেবে তিনি সারা ভারত নিয়ে চিন্তা করেন। তাই তিনি ২২ জানুয়ারি সংহতি দিবস পালনের ডাক দিয়েছেন। এ জন্য তিনি সব ধর্ম, সব বিশ্বাসের মানুষদের নিয়ে হাজরা থেকে পার্ক সার্কাস ময়দান পর্যন্ত মিছিল করছেন। মুখ্যমন্ত্রীর মিছিল এই বার্তা দেবে যে, এই ভারত সকল মানুষের জন্য। এখানে জাতপাত, ধর্মাধম, ভাষা এগুলির কোনও বিভেদ নেই। কারণ, ভারতের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সংবিধান সব নাগরিককে সমান অধিকার দিয়েছে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাজে রবীন্দ্রনাথের সেই প্রখ্যাত কবিতা ‘ভারত তীর্থেরই’ প্রতিফলন ঘটছে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘হেথায় আর্য, হেথা অনার্য, হেথায় দ্রাবিড়, চীন/ শক-হুন-দল পাঠান মোগল, এক দেহে হল লীন। পশ্চিম আজি খুলিয়াছে দ্বার, সেথা হতে সবে আনে উপহার, দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে/ যাবে না ফিরে, এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।…. হে রুদ্রবীণা, বাজো, বাজো, বাজো, ঘৃণা করি দূরে আছে যারা আজো, বন্ধ নাশিবে, তারাও আসিবে দাঁড়াবে ঘিরে এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।…. এসো হে আর্য, এসো অনার্য, হিন্দু মুসলমান/ এসো এসো আজ তুমি ইংরাজ, এসো এসো খৃস্টান/ এসো ব্রাহ্মণ শুচি করি মন ধরো হাত সবাকার/ এসো হে পতিত করো অপনীত সব অপমানভার….।’ রবীন্দ্রনাথ সবাইকে আহ্বান করেছেন, ‘ভারতের এই মহামানবের সাগর তীরে’ আসার জন্য। এটাই হচ্ছে ভারতের আসল চেতনা, ভারতের ঐতিহ্য। আর সেটাই রবীন্দ্রনাথের কবিতায় ফুটে উঠেছে।
তবে ভাগ্যিস রবীন্দ্রনাথ কবিতাটি লিখেছিলেন বহুদিন আগে। এখন এই ধরনের কবিতা লিখলে কট্টরবাদীরা তার শিরোচ্ছেদের জন্য হয়তো মরিয়া হয়ে উঠত। কারণ, তারা ঐক্য বা সংহতি নয়, তারা বিভদে ও বিভাজনের খেলায় মেতেছে।
বিস্ময়ের কথা, রাজ্য বিজেপি বাংলার রাজধানীতে এই ধরনের সংহতি মিছিলকে সহ্য করতে পারছে না। এই সংহতি মিছিল বন্ধ করার জন্য বঙ্গ বিজেপির এক নেতা হাই কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন। তবে হাই কোর্ট নিজ বিবেচনায় এই সংহতি মিছিলে কোনও নিষেধাজ্ঞা জারি করতে রাজি হয়নি। উচ্চ আদালত কয়েকটি শর্ত দিয়েছে। তবে এই শর্তগুলিরও দেওয়ার কোনও প্রয়োজনই ছিল না। তার কারণ, আদালত বলেছে কারও ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত লাগে এই ধরনের কোনও শ্লোগান বা মন্তব্য ওই মিছিলে যেন না দেওয়া হয়।
অবশ্য আগেই বাংলার মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন, তৃণমূলের এই সংহতি মিছিলের দিন তিনি মন্দিরে যাবেন, গুরদুয়ারায় যাবেন, গির্জা এবং মসজিদেও যাবেন। তিনি বার্তা দেবেন, সব ধর্মের মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি ও সহনশীলতার। সকলেই স্বীকার করবেন, আজকের ভারতে এই ধরনের মিছিল এবং সম্প্রীতি-সংহতির প্রয়োজন রয়েছে। প্রয়োজন রয়েছে সংহতি চর্চার। আর তাতে বাড়বে ভারতেরই শক্তি। যারা সংহতি চান না, তাঁরাই সংহতি মিছিল বন্ধের দাবি নিয়ে আদালতে উপস্থিত হয়েছেন।
এর মধ্যে হঠাৎই আসরে নেমে পড়েছেন বাংলার রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোস। কথা নেই বার্তা নেই, তিনি মুখ্যসচিবকে একটি চিঠি লিখে জানতে চেয়েছেন, ২২ জানুয়ারিতে অযোধ্যায় প্রধানমন্ত্রী মোদি কর্তৃক মন্দির উদ্বোধনের দিন রাজ্যে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? অনেকেই প্রশ্ন করছেন, মন্দির উদ্বোধনের দিন পশ্চিমবঙ্গের গভর্নর এই রাজ্যে কী ধরনের গণ্ডগোল ও অশান্তির আশঙ্কা করছেন? রাজ্যপালের কাছে কী ধরনের খবর রয়েছে? তা তিনি ঝেড়ে কাশুন না। তিনি বলে দেন, কী কী সুরক্ষার ব্যবস্থা কোথায় কোথায় এবং কার কার জন্য নিতে হবে? তবে রাজ্যপালের এই ধরনের প্রশ্ন যে শান্তি ও সম্প্রীতির রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে আশঙ্কার সৃষ্টি করেছে, তাতে কিন্তু সন্দেহ নেই।