পুবের কলম, ওয়েবডেস্কঃ করোনার টিকা নিখরচায় দেওয়া হচ্ছে ৪০ বছরের ঊর্ধ্বে পাক নাগরিকদের। কিন্তু জাতীয় পরিচয়পত্র (ভারতের আধার কার্ড) না থাকায় টিকা পেলেন না ৬৫ বছরের সোহনা আলি। আলি জানান– ‘যতবারই হাসপাতালে গিয়েছি– আমাকে ফেরত পাঠিয়েছে। আমার জাতীয় পরিচয়পত্র নেই। তাই টিকা হবে না। আমরা অসহায়। আমাদের আরাকান আবাদ কলোনির বাসিন্দাদের সকলেরই প্রায় একই অবস্থা। শুধু টিকা নয়– কোনও ধরনের চিকিৎসা সুবিধা আমরা পাচ্ছি না সরকারি হাসপাতাল থেকেও। আমাদের ছেলেরা সরকারি স্কুলে ভর্তি হতে পারছে না।’ পাকিস্তানের বিখ্যাত শহর করাচির এই কলোনিগুলিতে মানবেতর জীবনযাপন করছেন কয়েক লক্ষ বাঙালি মুসলিম। তাদের বহিরাগত তকমা লাগিয়ে দিয়েছে পাকিস্তান সরকার। অথচ এদের অনেকেই ১৯৭১ সালের আগে থেকেই পাকিস্তানে বসবাস করছেন।
পাকিস্তান বেঙ্গলি অ্যাকশন কমিটির চেয়ারম্যান সেখ মুহাম্মদ সিরাজ সংবাদমাধ্যমকে জানালেন– আমরা বাঙালি– তবে পাকিস্তানি বাঙালি। কিন্তু ওরা বলে আমরা নাকি বহিরাগত– শরণার্থী– বিদেশি– আমাদের নাগরিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। মুহাম্মদ সিরাজ ১৯৯৩ সাল থেকে বাঙালি মুসলিমদের স্বার্থ নিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তিনি জানান– প্রায় ২০ লক্ষ বাঙালি মুসলমান রয়েছে করাচির এই কলোনিগুলিতে। এদের বেশিরভাগেরই কোনও পরিচয়পত্র নেই। তারা বহিরাগত। বাংলাদেশ তৈরির আগে থেকেও যারা এখানে ছিলেন তাদেরও অনেকেরই এখন করুণ পরিণতি। তিনি বলেন– ২০১৮ সালে ইমরান খান বলেছিলেন তাঁর দল পিটিআই ক্ষমতায় আসলে বাঙালি মুসলমানদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। কিন্তু তিনিও অন্যান্য নেতা-মন্ত্রীর মতো কথা রাখলেন না। ইমকান ওয়েলফেয়ার অর্গানাইজেশনের চেয়ারম্যান আইনজীবী তাহেরা হাসান জানান– মাছের কলোনি যেখানে ভাঙাচোরা রাস্তা– ভাঙা ঘর-বাড়ি– টয়লেটের ভালো ব্যবস্থা নেই। অল্প পরিসরে প্রায় সাত লক্ষ মানুষ থাকছে। ৬৫ শতাংশের কোনও পরিচয়পত্র নেই। আর এদের অধিকাংশই বাঙালি মুসলিম। এর আগে আইডি কার্ড কিছু লোককে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু নাডরা হতে সেগুলি ব্লক করে দেওয়া হয়েছে। জন্মসূত্রে নাগরিক তত্ত্ব এখন আর মানতে চাইছে না ইমরান খানের সরকার। সিন্ধের স্বাস্থ্য অধিকর্তা ডা. ইরসাদ মেমন জানালেন– এটা সত্যি যে তাদের কার্ড নেই তাদের এখন টিকা দেওয়া হচ্ছে না। আমরা মনে করি– এই মহামারি পরিস্থিতিতে সবার জন্য টিকার ব্যবস্থা হোক। কিন্তু সরকারের নীতি মেনে চলতে হচ্ছে আমাদের। তবে আমরা অপেক্ষা করছি– হয়তো সবার জন্য টিকার নির্দেশ আসবে খুব শীঘ্রই। পাকিস্তান বহু শরণার্থীর আশ্রয় দিয়েছে। বাঙালি শরণার্থীদের বিষয়টি অবশ্যই বিবেচনা করা হবে। সিরাজ সাহেবের ধারণা– বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিক মহল একটু চাপ না দিলে তাদের আরও ৫০ বছর লেগে যাবে নাগরিকত্ব আদায় করতে।
ডিজিটাল পরিচয় পত্রের জন্য এখানে গঠিত হয়েছে ন্যাশনাল ডেটা বেস অ্যান্ড রেজিস্ট্রেশন অথরিটি (নাড়রা) ২০০০ সালে। যার ফলে সমস্যা বেড়েছে এই সব কলোনিতে। ডকুমেন্টস জোগাড় করতে পারছে না তারা। ঝাঁ-চকচকে করাচির পাশে এই সব কলোনির মানুষ বসবাসের অযোগ্য। এখানে রয়েছে পূতিগন্ধময় স্যাঁতসেঁতে আরাকান আবাদ। বেঙ্গলি পাড়া– ইত্তেহাদ টাউন– কোরাঙ্গি ও মাছের কলোনি। এখানে বাঙালি মুসলিমদের সঙ্গে রয়েছে বার্মা ও আফগানিস্তানের মানুষ। তাদের সংখ্যা প্রায় পাঁচ লক্ষ। মৎস্যজীবী বেশিরভাগ মানুষ। অনেকেই ৪০-৫০ বছর ধরে রয়েছেন। এখন ডিজিটাল কার্ড না থাকায় পদে পদে বিপদে পড়তে হচ্ছে তাদের। স্কুলে ভর্তির সুযোগ না পেয়ে নিজেদের তৈরি মাদ্রাসায় পড়াশোনা করতে বাধ্য হচ্ছে অনেকে। বেশিরভাগই স্কুলে যাওয়া থেকে মাছ ধরতে যাওয়ার দিকেই ঝুঁকছে বেশি। মানবাধিকার ও সমাজকর্মী আইনজীবী রানা আসিফ হাবিব জানান– পাকিস্তান আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদে স্বাক্ষরকারী এবং রাষ্টÉসংঘে শিশুর অধিকার সংরক্ষণ দলিলেও স্বাক্ষর করেছে। অথচ এই দেশে আন্তর্জাতিক বিধি ও নিয়ম-নীতির কোনও তোয়াক্কা নেই। এখানকার বাঙালি মুসলিমরা দীর্ঘদিন ধরে মানবেতর জীবনযাপন করছে। হাবিব বলেন– পাকিস্তানে স্পষ্ট আইন রয়েছে– ১৯৫১ সালে পাকিস্তান সিটিজেনশিপ অ্যাক্ট। পাকিস্তানের মাটিতে জন্মানো প্রতিটি শিশুই নাগরিক অধিকার পাবে এই আইন অনুযায়ী। কিন্তু বাঙালি মুসলিমদের জন্য এই আইন প্রযোজ্য হচ্ছে না। তাদের বহিরাগত তকমা লাগিয়ে যাবতীয় নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।