পুবের কলম,ওয়েবডেস্ক: মণিপুরে জাতিগত সহিংসতা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। কুকি ও মেইতেইদের মধ্যকার বিবদমান দাঙ্গা তিন মাস ছুঁতে চলেছে। মৃত্যু হয়েছে দেড়শোর বেশি মানুষের। কুকিরা মেইতেইদের হাতে চরমভাবে অত্যাচারিত হচ্ছে। উলটো চিত্রও দেখা যাচ্ছে কোনও কোনও জায়গায়। মণিপুরের অবস্থা এখন ফুটন্ত কড়াইয়ের মতো। এই পরিস্থিতিতে হিংসা-দীর্ণ মণিপুরের শান্তিরক্ষা ও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ। কুকি, মেইতেই সবাইকেই সাহায্য করছে। খুলে দিচ্ছে শরণার্থী শিবির। দিচ্ছে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র।
হিন্দু-সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেইরা মণিপুরের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫৩ শতাংশ। কুকিরা মূলত ক্রিস্টান, যারা ৪২ শতাংশ। ৫ শতাংশ মুসলিম সম্প্রদায়ের বসবাস। কুকিরা বাস করে পাহাড়ি অঞ্চলে। তারা এসটি-র অন্তর্গত। অন্যদিকে শাসনক্ষমতা রয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেইদের হাতে। মণিপুর হাইকোর্ট তাদেরকে এসটি স্ট্যাটাস প্রদানের নির্দেশ দেওয়ার পর থেকেই ফুটছে উত্তর-পূর্বের এই রাজ্য। ৩ মে-র পর থেকে কুকি-অধ্যুষিত এলাকায় যেসমস্ত মেইতেইরা বসবাস করতো, তারা নিজেদের প্রাণরক্ষা করতে নিরাপদ এলাকায় পালিয়ে যায়। আবার মেইতেই-অধ্যুষিত যেসব এলাকায় কুকিরা বসবাস করতো, তারাও প্রাণভয়ে পালিয়ে যায়। প্রতিবেশীর হাতে প্রতিবেশী নিধন শুরু হয়। মণিপুরি মুসলিম যাদেরকে ‘পাঙ্গাল’ বলা হয়, তারা ১৯৯৩ সালে এরকম সহিংসতার শিকার হয়েছিল মেইতেইদের হাতে। সেই সময় প্রায় ১৪০ জন মুসলিম হিংসায় প্রাণ হারায়। ক্ষতি হয় সম্পত্তিরও। কিন্তু মুসলিমরা সেসব মনে রাখেনি। অতীতকে ক্ষমা করে দিয়ে মেইতেইদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি কুকিদেরকেও সাহায্য করে চলেছে তারা। এর ফলে দুই গ্রুপের কাছ থেকেই হুমকি পেয়েছে মুসলিমরা। মেইতেইরা মুসলিমদের হুমকি দিয়ে বলেছে, কুকিদের সাহায্য করলে তোমাদেরও ওদের মতো পরিণতি হবে। একই ধরনের হুমকি এসেছে কুকিদের পক্ষ থেকেও। কিন্তু শান্তির বার্তা দিতে নিরস্ত করা যায়নি মুসলিমদের। প্রাণভয় উপেক্ষা করেই মুসলিমরা খাদ্য, আশ্রয়, জামাকাপড়, ওষুধ, পানীয় জলসহ অন্যান্য ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করছে কুকি-মেইতেইদের। এর ফলে অনেক মুসলিমকে আক্রমণের শিকারও হতে হয়েছে। তারা আহত হয়েও পিছিয়ে যায়নি। মুসলিম-অধ্যুষিত হাত্তা গোলাপাতি এলাকায় মেইতেই মুসলিমরা প্রচণ্ড সাহসিকতার সঙ্গে তাদের সাহায্যের দরজা খুলে দিয়েছে এবং ৩ হাজারের বেশি কুকিকে আশ্রয় দিয়ে তাদের জীবন রক্ষা করেছে।
চুড়াচাঁদপুরে আক্রান্ত হিন্দু-মেইতেইরা কোয়াকটা গ্রামে গিয়ে মুসলিমদের কাছে আশ্রয় নিয়েছে। সেখানে প্রায় ২০ হাজার মুসলিমের বসবাস। সেখানকার মুসলিমদের আর্থিক অবস্থা খারাপ হলেও তারা যথাসাধ্য চেষ্টা করে চলেছে তাদেরকে আশ্রয়, খাদ্য, জামাকাপড় দেওয়ার। নিজেদের বাড়ি থেকে জামাকাপড় নিয়ে মেইতেইদের সাহায্য করছে তারা। মসজিদ প্রাঙ্গনে খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখানকার মুসলিমরা কুকিদের নিকটবর্তী মেইতেই গ্রাম আক্রমণ করা থেকে বিরত রেখেছে। আবার কোয়াকটার নিকটবর্তী কুকি গ্রামকে মেইতেই আক্রমণের হাত থেকে বাঁচাতেও ভূমিকা নিয়েছে মুসলিমরা। বিভিন্ন মুসলিম সংগঠন বাড়ি বাড়ি গিয়ে রিলিফ সংগ্রহ করছে এবং ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। জমিয়তে উলামায়ে হি¨, জামায়াতে ইসলামি হিন্দ, অল মণিপুর মুসলিম অর্গানাইজেশন এই ত্রাণকাজে অংশ নিয়েছে। শান্তির দাবিতে তারা মিছিলও করেছে। ইন্টারফেথ ফোরাম ফর পিস অ্যান্ড হারমনি তৈরি করে শান্তির বার্তা দেওয়া হচ্ছে সংঘর্ষমান গোষ্ঠীগুলিকে। এভাবেই এই অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতে শান্তির দূত হিসেবে এগিয়ে এসেছে মুসলিমরা।