আহমদ হাসান ইমরান: ভারতবর্ষ বা হিন্দুস্থানের সরজমিন-এ ইসলাম এসেছে প্রায় ১০০০ বছর আগে। কেরল এবং অবিভক্ত বাংলার চট্টগ্রামে আরব বণিকরা ইসলামের পয়গাম নিয়ে এসেছিলেন। আর্যরা অবশ্য তারও অনেক আগে ভারতের আদি অধিবাসীদের পদানত করে এই দেশে কব্জা জমান। অবশ্য কেরল ও তামিলনাড়ু ছিল এর ব্যতিক্রম। ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলেও আর্যরা পৌঁছতে পারেননি। আর বাংলার বেশিরভাগ মুসলিমই হচ্ছেন ভূমিপুত্রদের বংশধর। তাঁরা উচ্চবর্ণের অত্যাচারে এবং মানবিক মর্যাদা লাভের আশায় ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। হিন্দুস্থানের মুসলিমরা নানাভাবে ভারতকে সমৃদ্ধ করেছেন।
কিন্তু আজ এই ভূমিতে তাঁদের অধিকার তো দূরে থাকুক, তাঁদের অবস্থানকেও মেনে নিতে পারছে না গৈরিক মনোভাবাসম্পন্ন দুষ্কৃতীরা।
আর এরই শিকার হতে হয়েছে বাংলার কিছু নিরীহ মুসলমানদের। দোষের মধ্যে তাঁরা যাচ্ছিলেন খাজা মইনুদ্দিন চিশ্তি (রহ.)-র মাজার জিয়ারত করার জন্য আজমীর শরীফে।
কিন্তু বিশ্ব হিন্দু পরিষদের গুন্ডারা বাংলার একটি জেলা থেকে যাঁরা বাস ভাড়া করে সড়কপথে আজমীর যাচ্ছিলেন, তাঁদের নিশানা করে।
এই আজমীর যাত্রীরা যখন উত্তরপ্রদেশ অর্থাৎ যোগী-রাজ্যের শাহজাহানপুরে পৌঁছন, তখনই তাঁরা কোনও অন্যায় না করা সত্ত্বেও অপমান-নির্যাতনের মুখে পড়েন।
তাঁদের অপরাধ হল, এই ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা আজমীরের পথে দিল্লি-লখনউ জাতীয় সড়কে নামাযের সময় যখন রিজার্ভ বাস থামিয়ে একপাশে জামাত করে নামায পড়তে শুরু করেন। তাঁরা ট্রাফিক বা কারও কোনও অসুবিধা ঘটাচ্ছিলেন না। তারা সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর উদ্দেশ্যে নামায পড়ছিলেন।
এই সময় শাহজাহানপুরের বিশ্বহিন্দু পরিষদের নেতা-কর্মীরা তাঁদের সামনে উপস্থিত হন। তারা এই আজমীর যাত্রীদের গালিগালাজ করতে থাকে এবং বলে, প্রকাশ্যে নামায পড়ার অপরাধে কান ধরে ওঠবোস করতে হবে। তারা এও হুমকি দেয়, এটা উত্তরপ্রদেশ এখানে প্রকাশ্যে নামায পড়তে দেওয়া হবে না। যারা উন্মুক্ত স্থানে নামায পড়বে তাদের জেলে যেতে হবে। বাংলা থেকে আগত আজমীর যাত্রীরা বাধ্য হয়ে ওঠবোস করেন। তাদের মাফ চাইতেও বাধ্য করা হয়। আর সেই ভিডিয়ো আপলোড করা হয় স্যোশাল মিডিয়ায়।
বাংলার এই আজমীর যাত্রীদের হেনস্থা ও অপমান চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়া হয়। তাদেরকে ক্যামেরার সম্মুখে ক্ষমা প্রার্থনা করতে বাধ্য করা হয়। এরপর তাদের ভয়ানক অপরাধের জন্য তাদেরকে পুলিশের হাতে সোপর্দ করা হয়। এই বিষয়ে পুলিশের অতিরিক্ত সুপার সঞ্জীব বাজপেয়ী বলেন, পশ্চিমবাংলার ১৮ জন ব্যক্তি একটি বাসে করে আজমীর যাচ্ছিলেন। তাদেরকে পাকড়াও করে তিলহার পুলিশ স্টেশনে নিয়ে আসা হয়। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তারা রাস্তার পাশে নামায পড়ছিলেন। এই ব্যক্তিদের কাছ থেকে একটি মুচলেকা নিয়ে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়। এই পুলিশ আধিকারিককে জিজ্ঞাসা করা হয় বিশ্ব হিন্দু পরিষদের যে দুষ্কৃতীরা এই মুসলিমদের মারধর ও অপমান করল, তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে?
জবাব এড়িয়ে গিয়ে ওই পুলিশ আধিকারিক বলেন, বাস ড্রাইভারেরকে জরিমানা করা হয় কারণ সে রাস্তার পাশে বাসটি সঠিকভাবে পার্ক করেনি। জানা গেছে, যারা বাংলার আজমীর যাত্রী মুসলিমদের হেনস্থা করে তাদের বিরুদ্ধে উত্তরপ্রদেশের পুলিশ কোনও ব্যবস্থাই নেয়নি। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের এক নেতা রাজেশ আওয়াস্তি রাস্তার পাশে একদিকে নামায পড়ার বিষয়টি পুলিশকে জানান। তিনি বলেন, আমি যখন দেখলাম রাস্তার একপাশে নামায পড়ছে, তাদেরকে আমি বলি, ‘তোমরা এখন যোগী আদিত্যনাথের উত্তরপ্রদেশে রয়েছো। এই রাজ্যে কোনও উন্মুক্ত স্থানে নামাজ পড়া অবৈধ।’
তবে পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ২০১৯ সালে যোগী সরকার একটি আদেশ দিয়েছিল, যে উৎসবের দিনগুলিতে রাস্তায় নামায পড়া যাবে। এটা এই জন্য করা হয়েছিল যে অনেক সময় জুম্মার নামায পড়ার জন্য মুসল্লিরা রাস্তাতেও ১০-১৫ মিনিটের জন্য জায়নামায বিছিয়ে নামায আদায় করতেন। উৎসবের সময় শোভাযাত্রা যাতে বাধাপ্রাপ্ত না হয় সেইজন্য এই সাময়িক আদেশ ছিল। তবে শুধু উন্মুক্ত জায়গা নয়, মাত্র কয়েকদিন আগে মোরাদাবাদ পুলিশ ২৬ জন মুসলিমের বিরুদ্ধে এফআইআর দাযের করে কারণ তারা নাকি বাড়ির ভিতরে নামায আদায় করছিল। আর সেটাই অপরাধ ধরে নিয়ে যোগী পুলিশ এফআইআর করে।
আজমীর যাত্রীদের সঙ্গে এই বর্বর আচরণ অনেক প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। রাস্তার পাশে কোনও ফাঁকা জায়গায় গাড়ি পার্ক করে নামায কিংবা খাওয়া-দাওয়া করলে সেটা কেন আইনবিরুদ্ধ হবে, তার কোনও ব্যাখ্যা ইউপির আধিকারিকদের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। সেখানে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের লেঠেলদের কথাই হচ্ছে আইন। পুলিশ প্রশাসন তাদের অঙ্গুলিহেলনেই ওঠে-বসে। এ রাজ্যে মুসলিমদের কোনও সুবিচার পাওয়ার আশা করাই বৃথা।
একটি প্রশ্ন অবশ্যই করা যায়। যখন হিন্দু তীর্থযাত্রীরা দক্ষিণ ভারতের তিরুপতিতে যান, দেখা গেছে ভক্ত যাত্রীরা বিজয়ওয়াড়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন রেলস্টেশনে নেমে খাওয়াদাওয়া-সহ পুজো পাঠ করছেন। বাসযাত্রীরা রাস্তার পাশে যাত্রা বিরতি করে বিশ্রাম নিচ্ছেন বা ভজন গাইছেন, ভগবানের নামকীর্তন করছেন। সেক্ষেত্রে কিন্তু হিন্দু মুসলিম-খ্রিস্টান কিংবা পুলিশ প্রশাসন কেউই আপত্তি করেন না। বরং ভক্তজনদের সহায়তা করেন। অমরনাথগামী তীর্থযাত্রীদের ক্ষেত্রেও সেই একই কথা। কিন্তু আজমীর যাত্রী মুসলমানদের সঙ্গে যে আচরণ করা হয়েছে, তাতে বোঝা যায় ইউপিতে নাগরিকদের অধিকার বলতে কিছু নেই। বিশেষ করে মুসলিমদের।
আরও দুঃখের কথা, এই ঘটনার নিন্দা করতে বিশেষ কাউকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি। বাংলার রাজনৈতিক দল কংগ্রেস, সিপিএম, ফরওয়ার্ড ব্লক বা কোনও মানবাধিকার সংগঠনও এই নৃশংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাননি। শুধুমাত্র ফুরফুরার জমিয়তে উলামা বাংলার দায়িত্বশীল পীর ইমরান সিদ্দিকী ও মাওলানা সাজ্জাদ হোসেন এই ঘটনার প্রতিবাদে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেছেন।
তবে মুসলিম-খ্রিস্টান-শিখ, দলিত বা আদিবাসীরা নিজ বাসভূমে এভাবে পরবাসী হয়ে কতদিন থাকবেন?