বহু ভারতীয় মনীষী মাত্র দেড় শতক আগে অপ্রাপ্তবয়স্ক বালিকাকে বিবাহ করেছিলেণ। নূপুর শর্মারা সেই সম্পর্কে আশ্চর্যজনকভাবে অজ্ঞ। আর আমাদের ভারতে আজও হিন্দু সমাজের মধ্যে ব্যপক বাল্যবিবাহ বজায় রয়েছে। তা দূর করতে নূপুর শর্মারা কোনও সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলেছেন,তা কিন্তু শোনা যায়না। সমগ্র বিষয়টির উপর দৃষ্টিপাত করেছেন আহমদ হাসান ইমরান
পয়গাম্বর হযরত মুহাম্মদ সা.-র জীবন ও কর্ম নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। যে ঐশী বার্তা নিয়ে তিনি এসেছিলেন এবং যেভাবে তিনি নিজের জীবন ও সমাজে তা প্রতিষ্ঠা করেছেন তাতে নিরপেক্ষ গবেষকরা তাঁকে পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ও সফল মানুষ বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর বিরোধী ওরিয়েন্টালিস্টরা অনেক তত্ত্বতালাশ করে পয়গম্বর মুহাম্মদ সা.-র যে ‘খুঁত’ বের করেছেন তার মধ্যে প্রথমেই রয়েছে যে মুহাম্মদ সা. মা আয়েশা রা.-কে যখন বিয়ে করেছিলেন তখন আয়েশা রা.-র বয়স ছিল মাত্র ৬ বছর।
অবশ্য এ সম্পর্কে কয়েকটি হাদিসের ভিত্তিতে এই কথা বলা হয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, হাদিসে শ্রেণিভেদ রয়েছে। কিছু হাদিসকে ‘দুর্বল’ বলেও চিহ্নিত করা হয় যদি তা বিভিন্ন মানদণ্ডে উত্তীর্ণ না হয়। কিন্তু সেগুলিকে হাদিস গ্রন্থ থেকে বাদ দেওয়া হয় না।
বিয়ের সময় উম্মুল মুমেনীন মা আয়েশা রা.-র বয়স কত ছিল তা নিয়ে বিস্তর মতভেদ রয়েছে। অনেক ইতিহাসবিদ্ গবেষণা ও ঐতিহাসিক তত্ত্ব প্রমাণের ভিত্তিতে বলেছেন, বিয়ের সময় হযরত আয়েশা রা.-র বয়স ছিল ১৬ বছর। আর তিনি দাম্পত্য জীবন শুরু করেছিলেন তার তিন বছর পর অর্থাৎ তাঁর বয়স যখন ছিল ১৯।
কিন্তু কথা হচ্ছে, হযরত মুহাম্মদ সা.-র সময়কাল ছিল আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে। সেই সময়ের প্রথা, সমাজ ব্যবস্থাকে আজকে প্রচারিত ইউরোপীয়ান মূল্যবোধ দিয়ে বিচার করার চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু খোদ ইউরোপে এখন বিয়ে কিংবা পার্টনারের সঙ্গে সহবাসের সরকারি ও বেসরকারি বয়স কত, সেদিকটাও একবার বিচার করে দেখা প্রয়োজন।
সেইসব কথায় যাওয়ার আগে আমরা মাত্র দেড়শো-দুশো বছর পূর্বে আমাদের নিজের দেশ ভারতে কী অবস্থা ছিল তার দিকে সামান্য দৃষ্টিপাত করছি। যেমন আমাদের অনেকেরই ভক্তি ও শ্রদ্ধার পাত্র এমন বহু মনীষী রয়েছেন য¥ারা সেইসময় বিয়ে করেছিলেন অপ্রাপ্তবয়স্কা বালিকাকে।
Reluctant Dubutante: Response of Bengali Women to Modernization, 1849-1905 —এই পুস্তকটি থেকে কিছু তথ্য তুলে ধরা হল—
সাতিহ্য সম্রাট, আনন্দমঠের স্রষ্টা ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বিয়ে করেছিলেন মাত্র ৫ বছরের এক শিশুকন্যাকে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিয়ে করেছিলেন ১১ বছরের মৃণালিনীকে। প্রখ্যাত পণ্ডিত রাজনারায়ণ বসু বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ১১ বছরের এক বালিকার সঙ্গে। শিবনাথ শাস্ত্রী ১০ বছরের এক বালিকাকে বিয়ে করেন। পণ্ডিত ও ধর্মপ্রচারক কেশবচন্দ্র সেন বিয়ে করেছিলেন ৯ বছরের এক বালিকাকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভ্রাতা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বিয়ে করেন ৮ বছরের বালিকাকে। সমাজ সংস্কারক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ৮ বছরের এক বালিকার পাণিগ্রহণ করেন। আর ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব এবং তাঁর সর্বশ্রদ্ধেয়া স্ত্রী মা সারদা দেবী যারা জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলের কাছে বরেণ্য তাঁদের উদাহরণও আমাদের সামনে রয়েছে। তাঁদের বিয়ে হয়েছিল যখন মা সারদা ছিলেন মাত্র ৫ বছর বয়সের। কিন্তু এজন্য তাঁদের উভয়ের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধার বিমাত্র ঘাটতি হয়নি। বরং তাঁদের শিক্ষা ও আদর্শ শতকের পর শতক ধরে আমাদের পথ দেখাবে। এই ধরনের অসংখ্য উদাহরণ শুধুমাত্র আমাদের দেশ থেকেই দেওয়া সম্ভব।
তবে এজন্য কেউই এই বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের দিকে আঙুল তোলেন না বা তাঁদের সমালোচনা করেন না। আর এই অবস্থান ভুল নয়, যথার্থ। তার কারণ হল দেড়শো-দুশো বছর আগে এটাই ছিল বিদ্যমান সামাজিক অবস্থা। তাই এইসব মনীষী, চিন্তাবিদ ও ধর্মগুরুদের সম্পর্কে কেউই কোনও নিয়ে বা খারাপ কথা উচ্চারণ করে না। হয়তো নূপুর শর্মারা এইসব মনীষীদের সম্পর্কে তেমন কিছুই জানেন না! কারণ, বাংলায় এসে বিজেপির তাবড় তাবড় নেতৃবৃ¨ যেসব কথা মাঝেমধ্যে উচ্চারণ করেছেন, তাতে তাঁদের জ্ঞানগম্যি ও ইতিহাস বোধের পরিচয় পেয়ে বাংলার মানুষ চমকে উঠেছে। কাজেই বিজেপির কেন্দ্রীয় মুখপাত্র নূপুর শর্মা যে অনেক কিছুই জানবেন না, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। তবে তিনি যে একেবারেই কিছু জানেন না তাও নয়। গেরুয়া বুদ্ধিজীবী ও প্রকাশনাগুলি যেসব বক্তব্য ও বইপত্র প্রচার করেছেন, সেগুলি নূপুর অ্যান্ড কোং আত্মস্থ করেছেন। তাতে সত্য কতটা, আর কতটা বিকৃত ইতিহাস এবং ঘৃণা-বিদ্বেষ, তা বিচার করে দেখার মতো বিবেক-বুদ্ধি নূপুরের কাছ থেকে আশা করা বোধহয় ঠিক হবে না।
১৫০০ বছর আগের কথা বাদ দিলাম। ২০০ বছরের ইতিহাসটিও না হয় ‘পুরনো’ হয়ে যাওয়ায় ধর্তব্যের মধ্যে রাখা হচ্ছে না। নূপুর শর্মারা কি জানেন, এই মুহূর্তে আমাদের প্রিয় ভারতভূমিতে কী হচ্ছে? সর্বশেষ সেনসাস পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, আমাদের দেশে ১ কোটি ২০ লক্ষ বালক-বালিকাকে পরিবার ১০ বছর বয়স হওয়ার আগেই বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। আর এই শিশু-বিবাহের ৮৪ শতাংশই হচ্ছে হি। বাল্যবিবাহের এই সংখ্যা জম্মু-কাশ্মীরের জনসংখ্যার প্রায় সমান। আর ভারতে বাল্যবিবাহের ওই পরিসংখ্যানের ৭.৮৪ মিলিয়ন (৬৫ শতাংশ) হচ্ছে বালিকা।
আইন হিসেবে কিন্তু রয়েছে, ভারতে বিবাহের আইনগত বয়স হচ্ছে মেয়েদের জন্য ১৮ আর ছেলেদের জন্য ২১ বছর। কিন্তু তা যে মানা হয় না, জনগণনার উপরোক্ত পরিসংখ্যানই তার প্রমাণ।
ইউরোপের খ্রীস্টান দেশগুলিতে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অপ্রাপ্তবয়স্ক ‘কুমারী মাতার’ সংখ্যা ব্যাপকভাবে বাড়ায় সমাজবিজ্ঞানীরা চিন্তিত। বিষয়টি আলাদা করে আলোচনার দাবি রাখে। তবে নূপূর শর্মাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, ভারতের হি¨ুদের প্রতিও কিন্তু তাদের কর্তব্য রয়েছে। ভারত থেকে বাল্যবিবাহ দূর করার জন্য তাদের আরও অনেক অনেক বেশি সক্রিয় হতে হবে। আশা করা যায়, নূপুর শর্মার বিজেপি থেকে ৬ বছরের বহিষ্কারের মেয়াদ শেষ হলে, তিনি হিন্দু সমাজ থেকে বালিকা মেয়েদের শোষণ এবং বাল্যবিবাহ দূর করতে কিছুটা হলেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন।