সংসদে এখন আর বিজেপির কোনও মুসলিম সদস্য থাকছে না। রাজ্যসভায় যে তিনজন ছিলেন, তাঁরাও বাদ। দেখা যাচ্ছে, ভারতের সবথেকে বড় রাজ্য উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি একজন মুসলিমকেও টিকিট দেয়নি। বিজেপি ক্রমশই নিজেকে ‘মুসলিম-মুক্ত দল’ হিসেবে বাস্তবক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে। অথচ বাজপেয়ী-আদবানির জমানায় এমন চিত্র ছিল না। তাই প্রশ্ন উঠেছে, ভারতে ২০ কোটি জনসংখ্যা সমন্বিত মুসলিম সংখ্যালঘুদের সম্পর্কে বিজেপির আসল কী? এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন জয়ন্ত ঘোষাল
বিজেপি-র দুই মুসলমান নেতা। একজন হলেন শাহনাওয়াজ হোসেন। তিনি এখন বিহারের গুরুত্বপূর্ণ ক্যাবিনেট মন্ত্রী। অন্যজন হলেন মুখতার আব্বাস নকভি। একজন শিয়া এবং অন্যজন সুন্নি। এই দু’জন নেতাকে যখন বিজেপিতে নেওয়া হল তখন বাজপেয়ী জমানা। লালকৃষ্ণ আডবাণীকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আপনি এত উদ্যোগ নিয়ে একজন উত্তরপ্রদেশের এবং অন্যজন বিহারের, এই দুই মুসলিম নেতাকে বিজেপিতে নিয়ে এলেন কেন? বিজেপি তো কোনদিনই মুসলমান ভোট পায় না। তার জবাবে আডবাণী বলেছিলেন, আমি জানি মুসলমান সমাজ এখনও বিজেপিকে বিশ্বাস করতে পারে না। তাই বিজেপিকে তারা ভোটও দেয় না। কিন্তু বিজেপি যে মুসলমান বিরোধী দল নয়, সেইটা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রয়োজন এই ধরনের মুসলিম কর্মীদের আরও বেশি করে দলে নিয়ে আসা। তাতে আর যাই হোক, বিজেপির বিরুদ্ধে তোলা সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগকে খণ্ডন করা যায়।
বাজপেয়ী-আডবাণীর যুগ থেকে এখন মোদি-অমিত শাহ’র যুগ।
এ হল বিজেপি-র রূপান্তরের কাহিনি। এখন বিজেপি সংসদে কোনও মুসলিম সদস্য থাকলই না। রাজ্যসভায় তিনজন নেতা ছিলেন যাদের মধ্যে নকভিও ছিলেন। তার মধ্যে তিনজনই এবার রাজ্যসভা থেকে বাদ পড়লেন। তারা যে শুধু রাজ্যসভার সদস্য ছিলেন তা নয়, রাজ্যসভায় বিজেপির সংসদীয় দলের উপনেতা ছিলেন। আবার মন্ত্রিসভায় রীতিমতো সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী ছিলেন। এ হেন নকভি রাজ্যসভা থেকে যখন টিকিট পেলেন না তখন সংবাদপত্রে ঘুড়ি উড়ল, বোধহয় কানপুর থেকে লোকসভার উপনির্বাচনে তিনি এবার প্রার্থী হবেন। দেখা গেল নকভি সেটাও হলেন না। তাহলে এটা কি বলা যায়, বাজপেয়ী-আডবাণীর সময় মুসলমানদের প্রার্থী করে এই বার্তা দেওয়ার চেষ্টা ছিল যে, বিজেপি মুসলমান-বিরোধী নয়। এখন কি তার উলটো পারসেপশন তৈরিতে মন দিয়েছে বিজেপি? কারণ উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনে কোনও মুসলিম প্রার্থী না করে বিজেপি বারবার এই বার্তা দিয়ে থাকে যে, বিজেপি আর যাই হোক, মুসলমান দরদী দল নয়। বিজেপির শীর্ষ নেতা অমিত শাহকে একবার জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, উত্তরপ্রদেশে বিজেপি কেন মুসলিম প্রার্থী দেয় না? তার জবাবে তিনি বলেছিলেন, যারা আমাদের ভোট দেয় না তাদের প্রার্থী করে লাভ কি? এর থেকে বোঝা যায়, বাজপেয়ী-আডবাণীর সময়কার বিজেপির রণকৌশল আর এখনকার বিজেপির রণকৌশলেও একটা মস্ত বড় ফারাক হয়ে গেছে।
এবার আসা যাক সাম্প্রতিক ঘটনায়। নূপুর শর্মা, বিজেপির এই মহিলা মুখপাত্র এখন গোটা দেশ জুড়ে সংবাদের শিরোনাম। নূপুর শর্মাকে আমি ব্যক্তিগত ভাবে চিনি। একেবারেই গোঁড়া মুসলিম-বিরোধী, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ টাইপ চরিত্র তাঁর নয়। তিনি শহুরে অভিজাত পরিবারের গৃহিনী। তিনি ল্যুটেন্স দিল্লিতে থাকেন। দিল্লি-বিজেপি থেকে তিনি উঠে এসেছেন। এমনকি, খুবই উদার জীবনযাত্রা নূপুর শর্মার। অন্য দলের নেতা-নেত্রীদের সঙ্গেও তাঁর ওঠাবসা, খানাপিনা। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কন্যা শর্মিষ্ঠার সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব। তা সেই নূপুর হঠাৎ পয়গম্বর সম্পর্কে এমন কটু কথা বলতে গেলেন কেন? উনি তো কট্টরবাদী নেত্রী বলে পরিচিত নন।
আমার মনে হয়, বিজেপিতে এই ধরনের মন্তব্য করলে কেরিয়ার দ্রুত ভালো হতে পারে? এমন একটি ধারনা বিজেপি নেতাদের মধ্যে গ্রথিত হয়ে গেছে। যেমন, বরুণ গান্ধি এখন না হয় নরেন্দ্র মোদির সমালোচক। আপনারা নিশ্চয়ই কেউ ভুলে যাননি যে, বরুণ যখন প্রয়াত আরএসএস নেতা সুদর্শনের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন, সেই সময় তিনি উত্তরপ্রদেশে গিয়ে মুসলিমদের সম্পর্কে ঠিক কী কী কথা বলেছিলেন যার জন্য তাঁকে প্রকাশ্য ক্ষমাও চাইতে হয়েছিল? আসলে আপনার যা বলার বলে দিলেন কিন্তু তার পরে আর দুঃখ প্রকাশ করলেও আসলে আপনার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যটা তো চরিতার্থ হয়ে যায়। অতীতেও উমাভারতী, কল্যাণ সিং, বিনয় কাটিয়ার সহ আরও অনেক বিজেপি নেতা কিন্তু এমনটাই করেছেন। এতে বিজেপির ভেতরে একটা হিন্দুত্ববাদী কট্টর ভাবমূর্তি তৈরি হয় যেটা বিজেপি রাজনীতিতে রিভিডেন্ট দেয়।
নূপুর শর্মা এই ধরনের মন্তব্য করার পরেও দীর্ঘদিন দেশের ভেতরে বা দেশের বাইরে কোনোরকম প্রতিক্রিয়াই দেখা যায়নি। এমনকি, বিরোধী নেতারাও যে খুব সোচ্চার হয়ে নূপুর শর্মাকে আক্রমণ করেছে এমনটা নয়। প্রায় এক সপ্তাহ পর ৩রা জুন সেদিন ছিল জুম্মাবার। ওইদিন কানপুরে এই নূপুর শর্মার বক্তব্যের প্রতিবাদে মুসলিম সংগঠন স্থানীয় বাজার বন্ধের ডাক দেয়। এই ঘটনাটাকে কেন্দ্র করে নামায পড়ার পর রীতিমতো হিন্দু ও মুসলমান, এই দুই গোষ্ঠীর সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়। ঘটনাচক্রে সেদিন দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতি, এঁরা দু’জনেই উত্তরপ্রদেশে ছিলেন। তখনও কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মুসলিম দুনিয়ার কোনও প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি।
গত ৫ জুন কাতার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। তাতে হইচই পড়ে যায়। ভারতের হাইকমিশনারকে ডেকে পাঠানো হয়। পাকিস্তান বিবৃতি দেয়। এই ঘটনায় ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া এবং একের পর এক রাষ্ট্র ভারতের নিন্দা করতে শুরু করে। তারপর বিজেপির পক্ষ থেকে বিবৃতি দিয়ে বলা হয়, নূপুর শর্মা ‘ফ্রিঞ্জ এলিমেন্ট’। এটা বিজেপির মূল দর্শন নয়। তাঁকে দল থেকে সাসপেন্ড করা হয়। সাসপেন্ড করা হলেও নূপুর শর্মার জীবন নাশের হুমকির জন্য তাঁকে পুলিশি নিরাপত্তা দেওয়া হয়। নূপুর শর্মা আবার পাল্টা টুইট করে বলেন, মুসলমান সমাজ শিবলিঙ্গ নিয়ে খারাপ কথা বলায় তিনি আবেগ-তাড়িত হয়ে এমন মন্তব্য করে ফেলেছেন। কারো যদি তাতে আঘাত লাগে তার জন্য তিনি দুঃখিত। তাঁর এই মন্তব্যে কিন্তু ক্ষমা প্রার্থনার আন্তরিকতা চোখে পড়েনি। সমগ্র ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পক্ষ থেকে কোনোরকম বিবৃতি আসেনি। প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ মহল থেকে বলা হচ্ছে, যেহেতু বিষয়টাকে মূল স্রোতের বাইরে ‘ফ্রিঞ্জ এলিমেন্ট’ বলা হয়েছে, সে কারণে এখন প্রধানমন্ত্রীর শীর্ষস্তর থেকে যদি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয় তাহলে বিতর্কটা আরও চাগাড় দেবে। তাতে হিন্দু-মুসলিম সংঘাত আরও বাড়তে পারে। তবে একজন রাষ্ট্রনেতার কাছ থেকে এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করাটা কিন্তু সাধারণ মানুষ প্রত্যাশা করে।
কোনও সন্দেহ নেই যে, নূপুর শর্মার এই মন্তব্যে প্রধানমন্ত্রী তথা সরকার বেশ বিপাকে পড়েছে। তার কারণ গুলো বলি, নরেন্দ্র মোদি এখন মুসলিম দুনিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্কটাকে শুধরানোর চেষ্টা করছেন। তার আবার অনেক গুলো কারণ আছে। এক হল সৌদি আরব। এমনকি, দুবাইয়ের ক্রাউন প্রিন্সের সঙ্গেও নরেন্দ্র মোদি বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছেন। তুরস্কের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তিনি মাঝে মধ্যেই কথা বলছেন। বিশ্ব রাজনীতিতে বিশেষত ইউক্রেনের যুদ্ধের পর মুসলিম রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা করার প্রাসঙ্গিকতাটাও বেড়ে গেছে। এই ঘটনার পর তেল রফতানি বন্ধ করে দেবে বলে সৌদি হুমকি দিয়েছে। আবার আফগানিস্তানের তালিবান সরকারের সঙ্গে রাশিয়ার সাহায্য নিয়ে ভারত সরকার সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে চাইছে। মস্কোতে তালিবানদের সঙ্গে বৈঠকের ছবি পর্যন্ত এখন সরকারি ভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। এখন আর গোপন বৈঠক নয়, ট্র্যাক ওয়ান বৈঠক। এ বছর সেপ্টেম্বর মাসে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের ভাই শাহবাজ শরিফের সঙ্গে কাজাকিস্তানের তাসখন্দে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বৈঠক হওয়ার প্রস্তুতি চলছে। কাশ্মীরে হিন্দুদের বিতারণের ঘটনা পীড়া দিচ্ছে মোদিকে।
কেননা, এত কান্ডের পরেও ওখানে জঙ্গি সন্ত্রাস বন্ধ হয়নি। তার ফলে এখন প্রায় ৩০-৪০ জন কাশ্মীরি নেতাদের ডেকে মোদি বৈঠক করেছেন। নভেম্বর মাসে কাশ্মীরে ভোট করার চেষ্টা চলছে। স্বায়ত্তশাসনের পথে হাঁটবে বলে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন মোদি। তাতে পাকিস্তানের সঙ্গেও শান্তি প্রক্রিয়া গড়ে তুলতে সুবিধে হবে। এইরকম একটা বিশ্ব পটভূমিতে নূপুর শর্মার এমন আলটপকা মন্তব্য সমস্যায় জেরবার করে দিয়েছে মোদিকে। এক্ষুনি কোনও ভোট নেই উত্তরপ্রদেশে অথবা বিহারে। উলটে আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় মোদির বিদেশনীতির জয়গাঁথা বিপন্ন হয়েছে এই ঘটনায়।
ভুলে গেলে চলবে না, ভারতের পাঁচজনের মধ্যে চারজনই হিন্দু। এদেশে এখনো দশ কোটির ওপরে মুসলমানের বাস। জনসংখ্যার নিরিখে মুসলমানকে ভারতের প্রান্তিক জনসমাজ বলা যায় কি? সংখ্যাটা পাকিস্তানের চেয়ে খুব কম নয়। বাংলাদেশের তুলনায় একটু বেশিই। মুসলমান জনসংখ্যার দিক দিয়ে বিশ্বে তৃতীয় বৃহত্তম স্থানে ভারত। হিন্দু এবং মুসলমানের সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক জীবন এখানে যেভাবে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে সেখানে ভারতকে হিন্দু-রাষ্ট্র হিসেবে গণ্য করা উদ্ভট ব্যাপার হয়ে যায়। তাই ভারতের ধর্মীয় বহুত্ব শুধু হিন্দু-মুসলমানের মধ্যেও সীমাবদ্ধ নয়। এখানে তো আরও নানা ধর্মের মানুষ বসবাস করেন। রাষ্ট্র যাতে কোনও একটা গোষ্ঠী অথবা ধর্মাবলম্বীদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করতে না পারে, আমাদের সংবিধান প্রণেতারা প্রথম থেকেই সেটা সুনিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন।
যে ঘটনাবলী আলোচনা করলাম তাতে সংবিধানের এই মূল ধারা থেকে ভারত বিচ্যুত হচ্ছে, এমনটাই ধারণা হওয়া কি স্বাভাবিক নয়? আমি পাঠককে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে বিরাট মুসলমান সমাজও কিন্তু সামিল হয়েছিল। এমনকি, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনেও যে কত মুসলমান সামিল হয়েছিলেন তার ওপর রীতিমতো গবেষণালব্ধ বহু তথ্য আমাদের সামনে রয়েছে। দেশভাগের সময় বিহারের বিশাল মুসলমান সমাজ পাকিস্তানে যেতে চাননি। উপরন্তু তারা এই দেশভাগের বিরোধিতা করেছিলেন। সে ব্যাপারেও যথেষ্ট একাডেমিক গবেষণা হয়েছে। এই সমস্ত বিচ্ছিন্ন ঘটনার মধ্যে দিয়ে একটাই কথা বলা যেতে পারে যে, ভারত কিন্তু বহুমাত্রিক বহুত্ববাদী দেশ। সেখানে নূপুর শর্মাদের মতো মানুষের রাজনৈতিক দর্শন যা এ যাবত বিজেপির ছাতার তলায় বিকশিত হয়েছে সেটি আর যাই হোক, ভারতীয়ত্বের পরিচায়ক নয়।