মিল্লাতের খিদমতে তাঁর নিবেদিত প্রাণ। সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও কওমের যে কোনও কাজে তিনি অংশ নেন। প্রচারবিমুখ এই মানুষটি নীরবে কাজ করে চলেছেন। কলকাতার তালতলার বাসিন্দা বছর ৭৬ এর সমাজকর্মী ও শিক্ষাবিদ আবু সালেহ মুহাম্মদ রেজওয়ানুল করিম। তাঁর সাক্ষাৎকার নিলেন ‘পুবের কলম’ প্রতিনিধি রফিকুল হাসান
আবু সালেহ সাহেবের পূর্বপুরুষ জনাব গিয়াসউদ্দিন সোহরাওয়ার্দি ১৪৯২ সালে ইরাকের বসরা থেকে দিল্লিতে চলে আসেন। দিল্লি থেকে তৎকালীন বাংলার রাজধানী গৌড়ে চলে আসলে সুবেদার আলাউদ্দিন হোসেন শাহ তাঁদেরকে ভুরসুট পরগণা জায়গির দেন। যা বর্তমানে হাওড়া জেলার জগৎবল্লভপুর– উদয়নারায়ণপুর ও আমতা এলাকা। যদিও পরবর্তীতে হুগলির বাঁদপুর ও কলকাতার তালতলায় তাঁরা পাকাপাকিভাবে বসবাস শুরু করেন।
আবু সালেহ সাহেবের পরদাদা মাওলানা আবদুল হাই মাদ্রাসা আলিয়ার হেড মৌলবী ছিলেন। তিনি বৃটিশদের থেকে সামসুল উলামা উপাধি পান। মাদ্রাসা আলিয়া থেকে অবসর নেওয়ার পর মাওলানা আবদুল হাই সাহেব ১৮৯৬ সালে ইলিয়ট হোস্টেলের সুপার নিযুক্ত হন। নবাব আবদুল লতিফ সাহেবের তিনি শিক্ষকও ছিলেন। আবু সালেহ সাহেবের আব্বা মুহাম্মদ আবদুল কাইয়ুম সাহেব শ্রীরামপুর কোর্টের ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। পরর্বতীতে কাইয়ুম সাহেবের ফুরফুরা শরীফের বিখ্যাত কাজী পরিবারের মেয়ের সঙ্গে বিবাহ হয়। আবু সালেহ সাহেবের নানিমা মাসুদা রহমান কবি কাজী নজরুল ইসলামকে লালনপালন করেছিলেন। তাই কাজী নজরুল ইসলাম ‘বিশের বাঁশি’ কাব্যগ্রন্থটিতে আবু সালেহ সাহেবের নানিমা মিসের্স এম রহমান (মাসুদা রহমান) কে উৎসর্গ করেন। এমনই সব পুরনো কথা বলতে গিয়ে নস্টালজিক হয়ে পড়েছিলেন আবু সালেহ রেজওয়ানুল করিম।
জানা যায়, সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান আবু সালেহ সাহেব হুগলির বাঁদপুরের একটি জুনিয়র মাদ্রাসা থেকে প্রাথমিক লেখাপড়া শেষ করেন। পরর্বতীতে মাদ্রাসা আলিয়া থেকে পড়াশোনা শেষ করে আবার তিনি মওলানা আজাদ কলেজ থেকে জেনারেল শিক্ষায় শিক্ষিত হন। সে সময় তিনি মওলানা আজাদ কলেজে ছাত্র নেতা সইদুল ইসলামের সঙ্গে কংগ্রেসের ছাত্র সংগঠন ছাত্র পরিষদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। যদিও পরবর্তীতে তাঁরা ছাত্র পরিষদ থেকে বেরিয়ে এসে ১৯৭১ সালে পশ্চিমবঙ্গ মাদ্রাসা ছাত্র ইউনিয়ন গঠন করেন। বর্তমানে ঐতিহ্যবাহী এই সংগঠনের দলাদলি নিয়ে ক্ষুব্ধ তিনি। শুধু তাই নয় আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান নানাবিধ সমস্যা প্রকাশ্যে না এনে টেবিলেই মিটিয়ে নেওয়ার পরামর্শ তাঁর। প্রয়োজনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হস্তক্ষেপেরও কথা বলেন আবু সালেহ সাহেব।
তাঁর কথায়, আমরা সেসময় দাবি করেছিলাম ১) আলিম– ফাজিল– কামিল ও এমএমকে, বিএ– এমএ -র সমমানের করতে হবে। ২) আলিয়া মাদ্রাসাকে ইউনিভার্সিটি করতে হবে। তিনি বলেন, এই ধরণের ছয় দফা দাবি নিয়ে কলকাতার কার্জন পার্ক বর্তমানে এসপ্ল্যানেড এলাকায় টানা ১৭ দিন ধর্ণা অবস্থান করি ছাত্রদের নিয়ে।
একদিকে আমরা আন্দোলন করছি– অপরদিকে বাংলাদেশের জন্ম হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে এ বাংলার একটা বৃহৎ অংশ শিক্ষিত বাঙালি মুসলমান ওপার বাংলায় চলে গেছে। এই সমস্ত আন্দোলনের সুবাদে তৎকালীন কংগ্রেস মন্ত্রিসভার স্বরাস্ট্রমন্ত্রী ফজলে হক, বিদুৎ মন্ত্রী গণিখান চৌধুরী, কৃষিমন্ত্রী আবদুস সাত্তার সাহেবদের কাছে নানা দাবিদাওয়া পেশ করতাম। পরর্বতীতে আবদুস সাত্তার মাদ্রাসা শিক্ষামন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব নিলে আমাদের অনেক দাবিদাওয়া মেনে নিয়ে মাদ্রাসা শিক্ষার উন্নয়ন হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন। যেমন মাদ্রাসা শিক্ষা পর্ষদের নির্দিষ্ট কোনও অফিস না থাকায় আমাদের আন্দোলনের ফলে তালতলায় আলিয়া মাদ্রাসার প্রিন্সিপালের কোয়ার্টারে নিদিষ্ট অফিস স্থাপন হয়। কিন্তু তার পরবর্তী সময়ে যতগুলি সরকার গঠন হয়েছে সেখানে ভালো শিক্ষিত মুসলমান ভালো মন্ত্রীর দায়িত্ব পান নি বলে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
বলাবাহুল্য, আবু সালেহ সাহেব ফুরফুরা শরীফের বড় হুজুর পীর কেবলা রহঃ এঁর একমাত্র জামাতা হন। পরবর্তীতে আল আমীন মিশন প্রতিষ্ঠা হলে ১৯৮৮ সাল থেকে টানা ১০ বছর তিনি আল আমীন মিশনের সভাপতি হিসাবে সুনামের সঙ্গে কাজ করে আসেন। বর্তমানে আল আমিন মিশনের হিসাবরক্ষক হিসাবে কাজ সামলে আসছেন আবু সালেহ সাহেব।
উল্লেখ্য, শিক্ষা সহ নানা সমাজসেবামূলক কাজে বড় হুজুর পীর কেবলা রহ এঁর ইন্তেকালের পর তাঁর মেজ সাহেবজাদা মরহুম পীরে কামেল আবু ইব্রাহিম সিদ্দিকী সাহেব সেই কাজের আনজাম দিয়ে আসছিলেন। বড় হুজুরের বাড়ির একমাত্র জামাতা হিসাবে ওই সমস্ত কাজে আবু ইব্রাহিম সাহেবকে সঙ্গ দিতেন আবু সালেহ সাহেব। সম্প্রতি আবু ইব্রাহিম সিদ্দিকী সাহেবও ইন্তেকাল করেছেন। তাঁদের ফেলে যাওয়া কাজ মরহুম আবু ইব্রাহিম সিদ্দিকী সাহেবের ভাইপো পীরজাদা সওবান সিদ্দিকী এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন বলে আশাবাদী আবু সালেহ সাহেব।
শুধু তাই নয় দাদা হুজুর ও পাঁচ হুজুর কেবলারা যখন ছিলেন ফুরফুরা শরীফের একটা গৌরবময় ঐতিহ্য ছিল। বর্তমানে ফুরফুরা শরীফে ডানপন্থী, বামপন্থী রাজনীতির প্রবেশ করায় সেই ঐতিহ্য ক্ষুণ্ণ হয়েছে বলে মনে করেন ফুরফুরা শরীফের জামাতা, শিক্ষাবিদ ও সমাজকর্মী আবু সালেহ রেজওয়ানুল করিম। তাঁর মতে, এখনও সময় আছে। প্রবীণদের সম্মান জানিয়ে সকলে এক ছাদের তলায় আসতে হবে। পাশাপাশি তিনি মনে করেন, বাংলার সংখ্যালঘু সমাজ যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে ধুকছে। তাই বিভিন্ন গণ সংগঠনের ৫-৬ জনকে এগিয়ে এসে মাজহাবগত দ্বন্দ্ব দূরে রেখে মিল্লাতের খিদমতে নেতৃত্ব দিতে হবে। তা না হলে সংখ্যালঘুদের উন্নয়নে কোনও গতি আসবে না। ফুরফুরা শরীফেও কোনও উন্নয়ন না হওয়ায় ক্ষুব্ধ তিনি। পাশাপাশি ওয়াকফ সম্পত্তি দিনের পর দিন ওই একই ভাড়ায় চলছে। কোথাও বেদখল হয়ে যাচ্ছে। আর এই নিয়ে কারো কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই বলে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
এছাড়া চাকরিতে মুসলিম প্রতিনিধিত্বের হার যেভাবে দিনের পর দিন তলানিতে ঠেকছে তা নিয়েও তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস বেঙ্গল প্যাক্ট তৈরি করেছিলেন। সেটাকে সামনে রেখে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায় দাঙ্গা ঠেকানোর জন্য প্রত্যেক থানায় দুজন করে মুসলিম অফিসার নিয়োগ দেন। কিন্তু বর্তমানেও তাঁরা অবসরগ্রহণ করছেন। এখনকার পরিবেশ পরিস্থিতিও খারাপ। ভোটের জন্য ধর্মনিরপেক্ষ সেজে থাকা অনেকেই সাম্প্রদায়িক রাজনীতির তাস খেলছে। বাংলার যে ঐতিহ্য ছিল তা নষ্ট করা হচ্ছে। তাই এই সমস্ত কাজে সকলকে এগিয়ে আসার বার্তা দেন শিক্ষাবিদ ও সমাজকর্মী তথা ফুরফুরা শরীফের সবার প্রিয় আবু সালেহ রেজওয়ানুল করিম।