বিশেষ প্রতিবেদকঃ ভারতের উত্তর-পূর্বে একটি ছোট রাজ্য ত্রিপুরা। ত্রিপুরার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল– এ রাজ্যটি একেবারে বাংলাদেশের পেটের ভেতরে। অর্থাৎ ত্রিপুরা তিনদিক থেকেই বাংলাদেশের সীমান্ত দিয়ে ঘেরা। এই ছোট রাজ্যটির রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস। এখানে আদিবাসী উপজাতিরাও বড় সংখ্যায় বাস করেন এবং তারা এখানকার ভূমিপুত্র। সব কিছু পালটে যায় ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হলে। তার আগে ত্রিপুরাই ছিল মুঘল এবং ব্রিটিশদের রাজত্ব। সম্রাট জাহাঙ্গিরের সময় থেকে ত্রিপুরার রাজারা মুঘলদের কর দিয়ে এখানে রাজত্ব করতেন। ভারত ভাগের পর এই ত্রিপুরা ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। আর তখন থেকেই ত্রিপুরার জনবিন্যাস পালটে যেতে থাকে। প্রথমে পূর্ব পাকিস্তান ও পরে বাংলাদেশ থেকেও প্রচুর বাংলাভাষী হিন্দু ত্রিপুরায় প্রবেশ করে সেখানকার উর্বর ভূমি দখল করে। আর বাংলাভাষী হিন্দুরা ধীরে ধীরে ত্রিপুরায় সংখ্যায়গুরু হয়ে ওঠে। আদিবাসী উপজাতিরা ব্যাপকভাবে সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়। ত্রিপুরার ‘রাজ্য ভাষা’ হয়ে যায় বাংলা। আর বাঙালিরাই মূলত ত্রিপুরা শাসন করতে থাকে। আর যাঁরা ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী হতে থাকেন– তাঁদের বেশিরভাগই বাঙালি ছিলেন।
ত্রিপুরা বাংলাদেশের পেটের মধ্যে হলেও এখানে কিন্তু কোনও মুসলিম অনুপ্রবেশ হয়নি। কেউ কখনও অভিযোগও করেননি যে– ত্রিপুরায় বাংলাদেশি মুসলমানরা অনুপ্রবেশ করেছে। ত্রিপুরার জনসংখ্যায় মোটামুটি ১০ শতাংশ মুসলিম। তারা এখানকার ভূমিপুত্র এবং ত্রিপুরায় প্রচলিত বাংলায় তারা কথা বলেন।
গর্ব ও বেদনার সঙ্গে বলতে হয়– বর্তমান সময়ের কলঙ্কজনক অশান্তি ছাড়া– ত্রিপুরায় কখনোই হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বা মারামারির কথা শোনা যায়নি। অথচ সেই সৌভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতির বন্ধনকে এবার সংঘ-পরিবারভুক্ত কিছু উগ্রপন্থী বিনষ্ট করে দেওয়ার চেষ্টা করল।
ত্রিপুরার বর্তমান অশান্তির কারণ কী?
দ্য ওয়্যার এবং নিউজলন্ড্রি সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে– অবস্থা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে– যখন বাংলাদেশে ‘পূজামণ্ডপ ও হিন্দুদের উপর আক্রমণে’র বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে বিশ্বহিন্দু পরিষদ এবং সংঘ-পরিবারের আরও কিছু সংগঠন মিছিল বের করে। মিছিলটি বের হয় পানিসাগর এলাকায়। কেউ কেউ বলছেন– এই মিছিলে ইসকনেরও সমর্থন ছিল। একটি ভিডিয়ো ভাইরাল হয়েছে– যাকে এখনও কেউ ফেক বলে দাবি করেনি। ওই ভিডিয়োতে দেখা যাচ্ছে– বিশ্বহিন্দু পরিষদের ব্যানারে মিছিল এগোচ্ছে– আর সেখানে হযরত মুহাম্মদের (সা.) নাম করে খুবই আপত্তিজনক শ্লোগান দেওয়া হচ্ছে। যেমন ‘মুহাম্মদ তেরা বাপ কৌন’। মিছিলকারীরা চিৎকার করে জবাব দেয় ‘হরে কৃষ্ণ হরে রাম’। মিছিলে এই ধরনের শ্লোগানের নিন্দা করেছেন ত্রিপুরার হিন্দু-মুসলিম সকলেই। স্বাভাবিকভাবেই এই শ্লোগান মুসলিমদের উত্তেজিত করে।
নিউজলন্ড্রি বলেছে– তারা বিশ্বস্ত সূত্র থেকে জেনেছে– সংখ্যালঘুদের উপর ত্রিপুরার ৫টি জেলায় এই ধরনের ১৯টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। ত্রিপুরায় মোট ৮টি জেলা রয়েছে। এ রাজ্যের মুসলিমরা মূলত বাস করেন ধর্মনগর– কৈলাশহর– বিশালগড়– উদয়পুরের নিকটবর্তী কয়েকটি এলাকা– সোনামুড়া প্রভৃতি জায়গায়। ত্রিপুরার মুসলিমদের অসমের বরাক উপত্যকার করিমগঞ্জ– হাইলাকান্দি ছাড়া অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ কম।
ত্রিপুরার মুসলিমরা এভাবে তাদের বাড়িঘর ও ধর্মস্থানের উপর হামলার শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে শামিল হয়েছেন। পানিসাগরের মিছিলে পয়গম্বরের প্রতি আপত্তিজনক শ্লোগানের পর থানায় অভিযোগ দায়ের করা হলেও দুষ্কৃতীকারীদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আজ শনিবার উনকুটি জেলার পুলিশ সুপারের অফিসের সামনে কালো ব্যাজ পরে শান্তিপূর্ণ গণঅবস্থান অনুষ্ঠিত হবে।
নাদওয়াতুত তামির প্রমুখ মুসলিম সংগঠনগুলির হিসেব অনুযায়ী– ১৬টি মসজিদে হামলা– ভাঙচুর কিংবা অগ্নি সংযোগের ঘটনা ঘটেছে। নাদওয়াতুত তামির এবং উত্তর-পূর্ব ভারত ইমারতে শারিয়াহ এই বিষয়ে প্রতিবাদ জানিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছেও চিঠি পাঠিয়েছেন। এই দুই সংগঠনের মুখপাত্ররা বলছেন– ত্রিপুরার মুসলমানরা নিরাপত্তার অভাব বোধ করছে। তারা দাবি করেছে– সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে অপরাধ সংগঠনকারীদের গ্রেফতার করতে হবে। যেসব বাড়ি বা ব্যবসা বিনষ্ট হয়েছে তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে এবং মসজিদগুলির পুনর্নির্মাণেও সরকারকে সহায়তা করতে হবে।
তবে বিজেপি শাসিত ত্রিপুরার পুলিশ ও প্রশাসন রাজ্যের সংখ্যালঘুদের উপর এই ধরনের হামলায়ও তেমন কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। বরং তারা ঘটনাগুলিকে চাপা দেওয়ার চেষ্টায় রয়েছেন। ত্রিপুরার একজন পুলিশ আধিকারিক বলেছেন– কোনও মসজিদ ভাঙা বা সংখ্যালঘুদের উপর হামলার ঘটনা ঘটেইনি।