জঙ্গি সন্দেহে ডোমকল থেকে ছ’জন ও কেরল থেকে আরও তিনজন সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার করেছিল জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা এনআইএ। তারপর কেটে গিয়েছে প্রায় সাড়ে তেরো মাস। গ্রেফতার হওয়া পরিবারের লোকেদের সঙ্গে কথা বলে ধারাবাহিকভাবে লিখছেন ‘পুবের কলম’ পত্রিকার প্রতিনিধি জিশান আলি মিঞা। দ্বিতীয় কিস্তি
২০২০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ভোররাতে জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা এনআইএ ও আধা সামরিক বাহিনীর জওয়ানেরা হানা দেয় মুর্শিদাবাদের সীমান্ত লাগোয়া একাধিক গ্রামে। রানিনগর থানার কালিনগর গ্রাম থেকে তদন্তকারীরা গ্রেফতার করেন বছর চল্লিশের আবু সুফিয়ান সেখ-কে। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে তিনি পেশায় দর্জি। গ্রামের মোড়েই তার দোকান। ওই দোকান চালিয়ে এবং অল্প বিস্তর জমি চাষ করে যা আয় হয় তা দিয়েই চার ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে সংসার যাপন করেন তিনি। স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে তিনি শান্ত প্রকৃতির– নির্বিবাদী বলেই পরিচিত। পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করতেন তিনি। জঙ্গি যোগে নাম জড়িয়েছে তারও। প্রায় সাড়ে তেরো মাস ধরে তার ঠিকানা নয়া দিল্লির তিহার জেল। পরিবারের লোকেদের অভিযোগ– তার সঙ্গে গ্রেফতার হওয়া অনেকেই পরিবার-পরিজনদের সঙ্গে মাসে অন্তত দু’চার দিন কথা বলতে পারে– মোবাইল ফোনে ভিডিয়ো কল করতে পারে। কিন্তু আবু সুফিয়ানের সঙ্গে গত প্রায় ছ’মাস ধরে পরিবারের লোকেদের যোগাযোগ করতে দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ। পরিবারের লোকেরাও টাকা পয়সা খরচ করে তিহার জেলে তাকে দেখতে যেতে পারেননি।
এই আবু সুফিয়ানের বাড়িতে ঘরের এক কোনে গর্ত খোঁড়া ছিল। পরিবারের লোকেরা তা শৌচাগারের চেম্বার তৈরির জন্য দাবি করলেও তদন্তকারীরা ওই বাড়ি দফায় দফায় গিয়ে তদন্ত করে তা সুড়ঙ্গ বলে দাবি করেন। যদিও পরিবারের লোকেরা এমনকী গ্রামের বাসিন্দারাও তা মানতে নারাজ। সুফিয়ানের বড় ছেলে বছর সতেরোর ওয়াসিম আক্রাম কাঠের কাজ করত। তার ব্যবহৃত যন্ত্রপাতিগুলিও বাজেয়াপ্ত করেন তদন্তকারীরা।
এখন ওয়াসিমের সামান্য রোজগার আর ছোট তিন ভাইয়ের স্কুল থেকে পাওয়া মিড-ডে মিলের খাদ্যসামগ্রী আর রেশন থেকে পাওয়া চালেই সংসার চলছে তাদের। সংসার চালাতে দেড় বিঘা চাষের জমিও বন্ধক রাখতে হয়েছে তাদের। ঘটনার পর থেকেই অনেকের বাঁকা নজরে পড়েছে পরিবারের লোকেরা। উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা বাড়িতে আর কাউকে পা মাড়াতে দেন না পরিবারের লোকেরা।
আবু সুফিয়ানের ৬-১০ বয়সি তিন ছেলের আতঙ্ক এখনও কাটেনি। বাড়ির সামনে অচেনা লোক দেখলেই আতঙ্কিত হয়ে জানালা দিয়ে দেখে ওই বালকেরা। আবু সুফিয়ানের স্ত্রী নুরুন্নেসা বিবি লোহার দরজার ওপার থেকেই বলেন– আল্লাহ্পাকই আমাদের দিন চালিয়ে দিচ্ছে। আমাদের কীভাবে দিন কাটছে তা আমরাই জানি। অর্থের অভাবে তারা কোনও উকিল ধরতে পারেননি বলে জানা গিয়েছে। তবে একটি মানবাধিকার সংগঠন তাদের হয়ে উকিল দিয়েছে বলে জানা গিয়েছে। সুফিয়ান নির্দোষ– তাকে ফাঁসানো হয়েছে বলে দাবি তার স্ত্রী নুরুন্নেসার। কবে জেল থেকে ছাড়া পাবেন সেদিকেই তাকিয়ে স্ত্রী সহ চার সন্তান।
জানা গিয়েছে, একই গ্রামের বাসিন্দা ভূমিহীন পরিবারের বছর ছাব্বিশের মুর্শেদ হাসান কেরলের এরনাকুলামের রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ করতেন। এলাকায় অত্যন্ত সাদামাটা বলে পরিচিত মুর্শেদকে কেরল থেকেই গ্রেফতার করেন তদন্তকারীরা। সে মোবাইল ফোন পর্যন্ত চালানো জানে না বলে দাবি পরিবারের লোকেদের। তার মা আম্বিয়া বিবি পাটকাঠির বেড়া ও ত্রিপলের ছাউনির বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে বলেন– আমার ছেলে যদি জঙ্গি কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকত তাহলে কি আমরা বেড়ার ঘরে বাস করতাম? যদিও এই প্রশ্নের উত্তর সকলের কাছেই অজানা। ভিন রাজ্যে কাজ করে ছোট দুই ভাইবোনকে পড়াশোনা করানো আর পাকা বাড়ি তৈরির স্বপ্ন ছিল মুর্শেদের।
মুর্শেদের বৃদ্ধ বাবা আবদুল মাতিন বলেন পরিবারের একমাত্র রোজগেরে ছিল আমার বড় ছেলে। মেজ ছেলে কাঠমিস্ত্রির জোগাড়ে কাজ করে যা আয় করে তা দিয়ে কষ্টেসৃষ্টে চলছে তাদের সংসার। সংসার চালাতে পাটের বিনুনি তৈরির কাজ করতে শুরু করেছেন মুর্শেদের প্রৌঢ়া মা। এই তেরো মাসে ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ করতেও পারেননি আম্বিয়া বিবি– আবদুল মাতিন দম্পতি। টাকার অভাবে দিল্লি যাওয়া তো দূরের কথা উকিল পর্যন্ত তারা ধরতে পারেননি বলে দাবি পরিবারের লোকেদের। মানবাধিকার সংগঠন যে উকিল দিয়েছেন– তাদের আশায় ও আল্লাহ ভরসায় দিন কাটাচ্ছেন মুর্শেদের পরিবার। প্রায় সাড়ে তেরো মাস ধরে চোখের জলে ভাসছে মুর্শেদের পাটকাঠির বাড়ি আর মাটির উঠোন। ছেলে কবে জেল থেকে ছাড়া পাবে সেই আশায় দিন গুনছেন মুর্শেদের পরিবারের লোকেরাও।