পুবের কলম, ওয়েবডেস্কঃ পবিত্র মাহে রমযানের এক মাস সিয়াম (রোযা) সাধনা মানবজীবনে শুদ্ধতা লাভের সুবর্ণ সুযোগ এনে দেয়। মহত্তর চারিত্রিক গুণাবলি অর্জন ও সত্যবোধকে জাগ্রত করার জন্য সংযম ও কৃচ্ছ্র সাধনার ভূমিকা ব্যাপক। ‘সাওম’ মানে ‘বিরত থাকা’। কুকর্ম কুচিন্তা ও ইন্দ্রিয় পরিচর্যা পরিহার করে সংযমী হওয়াই রোযার শিক্ষা। ‘রমযান’-এর শাধিক অর্থ ‘দগ্ধ করা’।
সিয়াম সাধনার উত্তাপে ধৈর্যের অগ্নিদহনে মুসলমান মাত্রই এই মাসে কুপ্রবৃত্তিকে দগ্ধ করে শুদ্ধ পরিশোধিত মানুষে পরিণত হয়। তাই রমযানুল মুবারক দৈহিক আত্মিক নৈতিক ও সামাজিক পরিশুদ্ধির প্রশিক্ষণের মাস। দিনে রোযা ও রাতে ইবাদাতের মাধ্যমে মানুষ দেহ-মনকে পরিশুদ্ধ করতে পারে এই রমযান মাসে। পবিত্রতা ও পরিশুদ্ধতার জন্য সিয়াম পালিত হয়ে থাকে। সিয়াম পালিত হয় চিত্তশুদ্ধি, পরিচ্ছন্নতা সত্যবোধ জাগ্রত রাখতে পার্থিব আকাঙ্ক্ষাকে নিবৃত্ত রাখা বিনয় ও নম্রতা প্রতিষ্ঠা সহমর্মিতা ও সৌহার্দ্যরে চেতনা উজ্জীবন সর্বোপরি মহান প্রভু আল্লাহ্ কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য।
আত্মিক পরিশুদ্ধি: সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মানুষ আত্মশুদ্ধি ও আধ্যাত্মিক পবিত্রতা অর্জন করে থাকে। আল্লামা ইবনুল কায়্যিম আল্-জাওজি বলেন : ‘মানুষের আত্মিক ও দৈহিক শক্তি সংরক্ষণে রোযা অত্যন্ত কার্যকর। একদিকে তা মানুষের পাশবিক চাহিদার প্রাবল্য থেকে মুক্ত করে তার দৈহিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার নিশ্চিয়তা বিধান করে, অপরদিকে তা নৈতিক উৎকর্ষ সাধনের মাধ্যমে আত্মিক সুস্থতা সাধন করে।’ মাসব্যাপী রোযার মাধ্যমে মানুষের জৈবিক চাহিদা ও পাশব প্রবৃত্তি দুর্বল হয়ে যায়, মনুষ্যত্ব ও রূহানিয়াত সজীব ও জাগ্রত হয়। রিপুর তাড়নামুক্ত হয়ে মানুষ আল্লাহ্-প্রদত্ত বিবেক ও প্রজ্ঞার সদ্ব্যবহার করে সুউচ্চ মর্যাদার অধিকারী হতে পারে।
সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মানুষ সৎকর্মের প্রতি ধাবিত হওয়ার প্ররোচনা লাভ করে এবং অসদুপায়ে সম্পদ পুঞ্জীভুত করার মানসিকতা লোপ পায়। আমরা সিয়াম পালনের ক্ষেত্রে চিত্তশুদ্ধির কথা বলেছি। চিত্তশুদ্ধি কাকে বলে, মানুষের চিত্ত সততই চঞ্চল। আমাদের চিত্তে নানা ধরনের ইচ্ছা জাগে এবং সেসব ইচ্ছার ভালো-মন্দ দুই-ই আছে। কিন্তু চিত্তকে শাসনে রেখে অপরাধের আগ্রহ থেকে মুক্ত রাখতে অত্যন্ত কঠিন। এখন এই কঠিন কাজটি কিভাবে সাধন করতে হবে? তার একটি প্রথাগত দিকনির্দেশনা আমরা সিয়াম সাধনার মধ্যে পেয়ে থাকি। রমযানের ব্যবহারিক নিয়ম-কানুন আমরা যদি পূর্ণভাবে পালন করি, তাহলে তার মধ্য দিয়ে চিত্তশাসন সহজেই কার্যকর হয়। একজন মানুষ যদি সারা দিন খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ না করে এবং সে সময়টুকুতে যদি সে মহান প্রভু আল্লাহ্তায়ালার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার সর্ববিধ কার্যক্রম গ্রহণ করে তাহলে তার চিত্তে পার্থিব আকাঙ্ক্ষা জাগবে না এবং অশুদ্ধ ও বিকল চিন্তায় চিত্ত ভারাক্রান্ত হবে না।
দৈহিক পরিশুদ্ধি: অতি ভোজন স্নায়ুকোষে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করে। রোযা দেহের জন্য প্রতিষেধকের কাজ করে থাকে। চিকিৎসা-বিজ্ঞানীদের গবেষণায় দেখা গেছে, উপবাসব্রতের কারণে দেহাভ্যন্তরে অ্যান্টিবায়োটিক শক্তি সৃষ্টি হয়, যার মাধ্যমে বহু ব্যাকটেরিয়া (জীবাণু), ভাইরাস ও জীবাণু মারা পড়ে। এক মাসের সিয়াম সাধনার উদ্দেশ্যে দিনের বেলা য’ন পানাহার বন্ধ থাকে, তখন পাকস্থলি ও অন্ত্রের ঝিল্লি দেহযন্ত্র থেকে জীর্ণ পদার্থগুলোকে বের করে দেয়। সারা বছর জৈব রসজাত যে বিষ দেহে জমা হয়, সিয়ামের আগুনে তা পুড়ে বিশুদ্ধ হয় বিষমুক্ত হয়। একজন রোযাদার রমযান মাসে তার প্রতিটি অঙ্গ, বিশেষত হাত-পা-চো’-মুখ- উদরকে অবৈধ ও গর্হিত কাজ থেকে বিরত রেখে সংযমী হয়। দেহের ওপর রোযার প্রভাব সুদূরপ্রসারী। ইচ্ছাশক্তিকে নিয়ন্ত্রণে রেখে দৈহিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে আল্লাহ্ নির্দেশিত পথে পরিচালিত করার শিক্ষা দেয় মাহে রমযান।
নৈতিক পরিশুদ্ধি: যখন রমযান মাস শুরু হয় মহান আল্লাহ্ জান্নাতের দরজা উম্মুক্ত করে দেন জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেন এবং শয়তানকে শৃঙ্খলিত করে রাখেন। যার কারণে ইবাদাত যিকির তেলাওয়াত কৃচ্ছ সাধনা ও আল্লাহ্ একনিষ্ঠ আনুগত্যের স্বর্গীয় পরিবেশ সৃষ্টি হয়। পানাহার ও পাপাচার ত্যাগ করলেই রোযা পালন হয় না, সেই সঙ্গে সর্বপ্রকার অন্যায় ও পাপ কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে এবং অন্তরকে করতে হবে পরিচ্ছন্ন। তবেই রোযা মুমিনের জীবনে নিয়ে আসবে অফুরন্ত রহ্মত ও বরকত।
এই প্রসঙ্গে মহানবী সা. বলেন: ‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি রোযা রাখছে সে যেন কোনও রকম অশ্লীলতা ও হই-হুল্লোড় না করে। কেউ যদি তাকে গালিগালাজ বা তার সঙ্গে ঝগড়া করে সে যেন বলে ‘আমি রোযাদার’। (বুখারী, মুসলিম)
রোযা ধৈর্য, সংযম ও নৈতিক উৎকর্ষের জন্ম দেয়। শিষ্টাচারের মাধ্যমে নৈতিক চরিত্র গঠন রমযানের সিয়াম সাধনার একটি মৌলিক শিক্ষা।
সামাজিক পরিশুদ্ধি: শুদ্ধতার এই অমোঘ মাসটিতে সাধনায় সিদ্ধি লাভ করার সুযোগ অবারিত হয়। সিয়ামের অর্থ হচ্ছে তাক্ওয়ার (খোদাভীতির) অনুশীলন আর তাক্ওয়ার অনুশীলনই অপরাধমুক্ত সমাজ তৈরির অন্যতম হাতিয়ার। রমযান মানুষের মধ্যে মানবিকতাবোধের উন্মেষ ঘটায়। মহানবী সা.-এর ভাষায় : সহমর্মিতা ও সৌহার্দ্যরে মাস মাহে রমযান। (রায়হাকী)
কেননা, ধনী ও বিত্তশালীরা সারাদিন রোযা রেখে, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জঠর জ্বালার দহন-বেদনা বুঝতে সক্ষম হন। ফলে তাদের মধ্যে সমাজের বঞ্চিত ও অবহেলিত মানুষের প্রতি সহমর্মিতার অনুভূতি জাগ্রত হয়। রমযান মাসে দরিদ্র অভাবগ্রস্ত মানুষের কল্যাণে অর্থ ব্যয় করা অত্যন্ত সাওয়াবের (পুণ্যের) কাজ। মহানবী সা. বলেন :’হে আয়েশা! অভাবগ্রস্তকে ফেরত দিয়ো না। একটি খেজুরকে টুকরো টুকরো করে হলেও দান করো। দরিদ্র মানুষকে ভালোবেসে কাছে টানো। কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ্ তোমাকে কাছে টানবেন।’
সমাজের প্রতিটি সদস্য সিয়াম সাধনার (রোযার) ফলে অর্জিত সহমর্মিতার শিক্ষা বছরের বাকি ১১ মাসে যদি অনুশীলন করতে পারে, তাহলে ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত পৃথিবী গড়া সম্ভব। রমযান মাস এলে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী নিত্য-ব্যবহার্য ‘দ্রব্যসামগ্রী মওজুদ করে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে অত্যধিক মুনাফা লাভের আশায়। এটা অত্যন্ত গর্হিত ও অন্যায় কাজ। মহানবী সা. বলেছেন :’মওজুদদার অভিশপ্ত।’
রমযানে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ-লালস কামনা-বাসনা প্রভৃতি অন্যায় আচরণ পরিহার করে মানবীয় জীবনের দীক্ষা গ্রহণের সুযোগ লাভ করে থাকে। অতএব মাহে রমযানের সিয়াম (রোযা) সাধনা আল্লাহ্ পাকের এক অপূর্ব নিয়ামত যা অফুরন্ত কল্যাণের পথ উন্মোচিত করে।