পুবের কলম,ওয়েবডেস্ক: অন্যায়ভাবে গ্রেফতারের কারণে রফিককে জীবনের সাত-সাতটি বছর হারাতে হয়েছে। তখন তাঁর বয়স মাত্র ২১। ৩১ জুলাই, ২০১৩, মুম্বইয়ের একটি দায়রা আদালত তাকে ৭৪ বছরের এক মহিলাকে ধর্ষণ এবং খুনের অভিযোগ থেকে বেকসুর খালাস দেয়। বিচারক বলেন, সম্ভবত পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রমাণ সাজিয়েছিল। কিন্তু তখন তাঁর জীবনের অনেকগুলি বছর নষ্ট হয়ে গেছে। আদালতের রায়ে যেদিন মুম্বইয়ের আর্থার জেল থেকে মুক্তি পেল তাঁর বয়স তখন ২৮, চেহারায় তারুণ্য সুলভ ঔজ্জ্বল্য তখন সে হারিয়ে ফেলেছে, মাথাভর্তি চুলের রঙে বাদামি ছিটে দেখা দিয়েছে।
রফিকের অসুস্থ মা জুবেইদা বেগম জানান, ‘অন্য সবার জন্য ৭ বছর মনে হতে পারে, কিন্তু আমার জন্য ১৪ বছর হয়ে গেছে। এখন আর ওর সেই তারুণ্য কমনীয়তা নেই যা আমার আগের রফিকের চেহারায় ছিল।’ তবে রফিকের বাবা ৫৫ বছরের মুহাম্মদ চৌধুরী এখন স্বস্তি পেয়েছেন তাঁর ছেলে মুক্ত, কিন্তু তিক্ততা তাঁরও মনে রয়ে গিয়েছে। তিনি বলেন, ‘পুলিশ বুঝে নিয়েছিল, ও জম্মু-কাশ্মীরের এক প্রবাসী যুবক, যার জন্য লড়তে ২০০০ কিমির বেশি রাস্তা অতিক্রম করে কেউ মুম্বইয়ে আসবে না। রফিক জম্মুর রাজৌরি জেলার দরহাল ব্লকের প্রত্যন্ত গ্রাম নেদিয়ায় ট্যুরিস্ট ভেহিকেল কেনার জন্য টাকা জমাচ্ছিলেন। কিন্তু সেই পরিকল্পনা এখন তাঁর কাছে সুদূরপ্রসারী মনে হচ্ছে। জেলমুক্তির ১২ দিন পর দ্য প্রিন্ট রফিকের সঙ্গে দেখা করলে তিনি জানান, ‘জেলে থাকাকালীন আমার মা খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েন। এখন আমি তাঁর দেখাশোনা করতে চাই।’
এখন রফিক মুম্বই ফিরে এসেছেন। তিনি মধ্যবিত্ত আবাসন সোসাইটিতে প্রহরী হিসেবে পুনরায় চাকরিতে বহাল হয়েছেন, যেখানে তিনি আগে চাকরি করতেন। সোসাইটির মানুষ তাঁকে উন্মুক্ত হাত দিয়ে তাঁকে স্বাগত জানিয়েছেন। ‘ওরা একজন নির্দোষকে গ্রেফতার করেছিল যা আদালতে প্রমাণ হয়ে গিয়েছে।’ যোগেশ্বরী (পশ্চিম) ওশিয়োরার বাসিন্দা এবং রিজওয়ান কো- অপারেটিভ সোসাইটির প্রাক্তন সভাপতি আসিফ গুলামরসুল বলেন, ‘কে কি বলল তাতে আমাদের কিছু আসে যায় না। আমরা শুধু চাই সে ফের আমাদের জন্য কাজ করুক।’ এক দিক থেকে, রফিকের জীবন সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছে, যা ২০১৬ সালে একজন বাসিন্দার নৃশংস হত্যার সঙ্গে শুরু হয়েছিল।
পাহাড়ের চূড়ায় সবুজের সমারোহে তাঁর বাড়িটা যেন থমকে গিয়েছে। অকেজো বাল্বগুলো ছাতে ঝুলছে, দেওয়ালের পলেস্তারা জায়গায় জায়গায় খসে পড়েছে এবং তারগুলো আলগাভাবে ঝুলছে। বাড়ির সামনের হাওয়ায় দোলখাওয়া ভুট্টার ক্ষেত শুকিয়ে গিয়েছে, যাকে গত কয়েক বছরে কেউ যত্ন নেয়নি।
ক্লাস নাইনে পড়ার সময়ই ২০১২ সালে রফিক জম্মুর একটি ছোট গুজ্জর মুসলিম বসতি থেকে মুম্বইয়ের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেয়। সে সময় রিজওয়ান হাউসিং সোসাইটির বলী মুহাম্মদ নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে কাজ করতেন এবং ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে পরিকল্পনা করছিলেন। রফিককে তাঁর তত্ত্বাবধানে ট্রেনিং নিয়ে সোসাইটির রক্ষী হিসেবে কার্যভার সঁপে দিয়ে নিজে জম্মুতে পরিবারের কাছে ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। বলী জানান, ‘পাহাড়ে নতুন ঘর তৈরির জন্য পর্যাপ্ত অর্থ ছিল না। গ্রামের অধিকাংশ পুরুষ কাজের জন্য মুম্বই, সৌদি আরব বা কাতার চলে যায়। আমার বড় ছেলে কাতারে যাওয়ার আগে ক্যাব ড্রাইভার হিসেবে এবং সোসাইটির রক্ষী হিসেবে কিছুদিন কাজ করেছিলেন। আমার মনে হয়েছিল এবং রফিকের উচিত রোজগার করা।’ রফিক জানান, তিনি সোসাইটি অফিসে রেজিস্টার মেইনটেন, সিসিটিভিতে নজর রাখা, বাচ্চাদের স্কুলে দিয়ে আসা এমনকী আবাসিকদের জন্য দোকান থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে আনার কাজও করেন। এই কাজে তাঁকে প্রতি মাসে ১৮ হাজার টাকা দেওয়া হয়। এছাড়াও রাতে ক্যাব চালিয়ে আরও ১০-১২ হাজার টাকা রোজগার করেন। একসময় সোসাইটির সভাপতি গুলামরসুল জানান, ‘ওর উপর আমরা নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলাম। কারণ ও খুবই সৎ এবং হেল্পফুল ছিল, কারোর ক্ষতি করত না।’
১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ সালের ঘটনা। আবদুল রশিদ সকাল ৯টায় ৭৪ বছরের স্ত্রী মুমতাজকে ছেড়ে কাজে বেরিয়ে যান। ফোনে তাঁকে না পেয়ে চিন্তিত আবদুল পাশের সোসাইটিতে থাকা তাঁর নাতি জুনেইদ বাদশাহকে ফোন করেন এবং স্ত্রী মুমতাজের খবর নিতে বলেন। জুনেইদ দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে দেখেন তাঁর নানির দেহ গলা কাটা অবস্থায় মেঝেয় পড়ে রয়েছে। পুলিশ সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখেন এবং তিনদিন পর রফিককে থানায় ডেকে পাঠায় এবং সে থানায় পৌঁছলে তাঁকে লকআপে ভরে দেয়। ১১, ১২ ফেব্রুয়ারি তদন্তের পর রফিককে পুলিশ ছেড়ে দেয় এবং বাড়ি ফিরে যেতে বলে। এরপরই মুম্বই পুলিশ দরহাল পুলিশ স্টেশনে গিয়ে হাউস অফিসারকে জানান, রফিককে মুম্বই নিয়ে যেতে হবে কারণ সোসাইটির লোকেদের অভিযোগ রফিক তাদের কিছু না বলেই চলে এসেছে। এসএইচও রফিক স্বেচ্ছায় মুম্বই যাচ্ছে এই মর্মে একটি শপথপত্রে স্বাক্ষর নিয়ে মুম্বই যাওয়ার অনুমতি দেন। রফিক জানান যে পুলিশ অফিসাররা পথে তাঁর সঙ্গে হাসি-ঠাট্টা করছিলেন মুম্বই স্টেশনে নেমে তাদের ভোল বদলে যায়। তাঁর সঙ্গে একজন কয়েদির মতো আচরণ শুরু করে।
পুলিশ জানায় রফিককে রক্ষীর চাকরি থেকে বরখাস্ত করা এই ভয়ে সে মুমতাজকে খুন করে। কিন্তু রিজওয়ান সোসাইটি মামলা স্পষ্টীকরণের জন্য প্রেস কনফারেন্স ডাকে। সেখানে প্রমাণ হয় পুলিশ পুরো মামলাতে রফিককে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। রফিক স্বীকারোক্তি পত্রে সই করে ফেলেছিল। অবশ্য যে পত্রে সে স্বাক্ষর করেছিল তা লেখা হয়েছিল মারাঠি ভাষায়। রফিককে একরকম বাধ্য করা হয় সই করতে। সোসাইটি থেকেই আইনজীবী নিয়োগ করা হয়।
রফিক জানান, জেলেও আমি সবার থেকে আলাদা ছিলাম। আমাকে হতাশা ক্রমে গ্রাস করছিল। সেখানে বাকি কয়েদিরা আমাকে বলত ‘তোমরা কাশ্মীরিরা এমনই।’
রফিক জানান, ‘পুরো মামলাই পুলিশকর্মীরা নিজেরা তৈরি করেছিলেন। আমি বলছি না ওঁরা আমাকে ফাঁসিয়েছে, কিন্তু আমি জম্মু-কাশ্মীরের গুজ্জর মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত, তাই ওরা নিশ্চিতভাবে ভেবেছিলেন সুদূর গ্রাম থেকে কেউ আমাকে খুঁজতে মুম্বই আসবে না।’