পুবের কলম, ওয়েবডেস্ক: চপার দুর্ঘটনায় ইন্তেকাল করেছেন ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি। তাঁর এই অকালপ্রয়াণে শোকস্তব্ধ গোটা বিশ্ব। রবিবার মৃত্যুর কয়েকঘণ্টা আগে তিনি ইরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে একটি বাঁধ উদ্বোধনের সময় ফিলিস্তিনিদের প্রতি ইরানের সমর্থনের ওপর জোর দিয়ে রাইসি বলেন, ‘ফিলিস্তিন মুসলিম বিশ্বের প্রথম ইস্যু’।
কে ছিলেন এই ইব্রাহিম রাইসি। ৬৩ বছর বয়সী এই প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাকে এককথায় বিশ্লেষণ করা সহজসাধ্য বিষয় নয়। বলা যেতে পারে, রাইসির প্রয়াণ এক রাজনৈতিক যুগের অবসান। তাকে দীর্ঘদিন ধরেই ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির স্বাভাবিক উত্তরসূরি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ২০২১ সালে দ্বিতীয় দফায় নির্বাচন করে ইরানের অষ্টম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ইব্রাহিম রাইসি।
ইরানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মাশহাদে ১৯৬০ সালে জন্ম নেন ইব্রাহিম রাইসি। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে বাবাকে হারান তিনি। রাইসির বাবাও ছিলেন ধর্মগুরু।
শিয়া ধর্মীয় ঐতিহ্য অনুযায়ী ইসলামের নবীর বংশধরদের মতো কালো পাগড়ি পরতে দেখা যেত তাঁকে। বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে ১৫ বছর বয়সে কুম শহরে এক শিয়া মাদ্রাসায় যোগ দেন তিনি। আন্তর্জাতিক আইনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। শহিদ মোতাহারী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেসরকারি আইনে বিশেষীকরণসহ আইনশাস্ত্র এবং আইনের মৌলিক বিষয়ে পিএইচডি লাভ করেন। সেখানে শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায়, তিনি পশ্চিমা সমর্থিত শাহ-এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে অংশ নেন। অবশেষে ১৯৭৯ সালে আয়াতোল্লাহ রুহুল্লা খোমেনির নেতৃত্বে ইসলামি বিপ্লবের মাধ্যমে শাহ-এর শাসনের পতন ঘটে। ছাত্র অবস্থা তিনি সক্রিয় ছিলেন। ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর বিচার বিভাগে যোগ দেন তিনি। আয়াতোল্লাহ খামেনির কাছে প্রশিক্ষণের সময় বেশ কয়েকটি শহরে প্রসিকিউটর হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮১ সালে ইরানের রাষ্ট্রপতি হিসাবে দায়িত্ব খামেনি।
রাইসির তার স্ত্রী জামিলে তেহরানের শহিদ বেহেস্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা, এবং তাদের দুটি সন্তান আছে। তার শ্বশুর আয়াতোল্লাহ আহমাদ আলামোলহোদা। তিনিও একজন কট্টরপন্থী ধর্মীয় নেতা এবং মাশহাদ শহরে জুম্মার নামায পরিচালনা করেন।
বিচার বিভাগীয় ক্ষেত্রে দীর্ঘ ৪০ বছরের অভিজ্ঞতা ছিল ইব্রাহিম রাইসির। তার নির্বাচনি বিতর্ক এবং প্রচারাভিযানের সময় বিচার বিভাগীয় প্রধান হিসাবে নিজের কর্মকাণ্ডকে ‘সফল’ হিসাবে দাবি করলেও, অনেকেই মনে করেন তিনি দায়িত্বে থাকাকালীন বিচার ব্যবস্থার তেমন কোনও পরিবর্তন হয়নি। মানবাধিকার কর্মী ও রাজনৈতিক কর্মীদের গ্রেফতার এবং সাজা দেওয়া, পরিবেশ কর্মীদের লাগাতার আটক করা, নাভিদ আফকারি এবং রুহুল্লাহ জাম-সহ একাধিক ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ডের মতো বিভিন্ন অভিযোগ এসেছে তার সময়কালে।
এর পাশাপাশি বেশ কয়েকটি ওয়েবসাইট এবং মেসেঞ্জার বন্ধ করে দেওয়া, সাংবাদিকদের গ্রেফতারের মতো ঘটনাও তার দায়িত্বে থাকাকালীন সময়েই ঘটেছে বলে অভিযোগ।
প্রসঙ্গত, বিচার বিভাগে চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে এব্রাহিম রাইসি যে সমস্ত দায়িত্ব পালন করেছেন সেগুলোর জন্য দায়বদ্ধ থাকার কথা স্বীকার করেছিলেন তার এক বক্তব্যে।
বিচার বিভাগীয় ক্ষেত্রে খুব অল্প বয়সেই সাফল্য অর্জন করেছিলেন তিনি। ডেপুটি কৌঁসুলি নিযুক্ত হন ইব্রাহিম রাইসি। ১৯৮৮ সালে এক গোপন ট্রাইব্যুনাল বসেছিল, যা ‘ঘাতক কমিটি’ নামেই পরিচিত ছিল। ওই ট্রাইব্যুনালের চারজন বিচারপতির মধ্যে একজন ছিলেন ইব্রাহিম রাইসি। তেহরানের ডেপুটি কৌঁসুলি পদে থাকাকালীনই ওই ট্রাইব্যুনালের অংশ ছিলেন তিনি। ইব্রাহিম রাইসি তার কর্মজীবনের বেশিরভাগ সময় সরকারি কৌঁসুলি হিসেবে কাজ করেছেন।
১৯৮০ এর দশকে রাজনৈতিক বন্দিদের যেভাবে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে তাতে রাইসির ভূমিকা নিয়ে বহু ইরানি এবং মানবাধিকার কর্মী উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ইরান কখনো এই গণ মৃত্যুদণ্ডের কথা স্বীকার করেনি। রাইসির ভূমিকা নিয়ে যেসব অভিযোগ তোলা হয়েছে সে বিষয়ে তিনি কখনো কিছু বলেননি।
রাষ্ট্রীয় পরিদর্শক সংস্থার প্রধান হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছেন রাইসি। ইরানের বিচার বিভাগের প্রথম উপ-প্রধান পদে নিযুক্ত হন এবং ২০১৪ সালে ইরানের মহাকৌঁসুলি (প্রসিকিউটার জেনারেল) পদের দায়িত্ব পান।
দুই বছর পর আয়াতোল্লাহ খামেনি ইরানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং সম্পদশালী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান আসতান-ই কুদস্-ই রাজাভি দেখাশোনার সব দায়িত্ব তুলে দেন রাইসির হাতে।