পুবের কলম প্রতিবেদক: কলকাতার সায়েন্স কংগ্রেস হল ছিল পরিপূর্ণ। পশ্চিমবাংলার বিভিন্ন জেলা থেকে শিক্ষাপ্রেমী এবং শিক্ষাসেবী বুদ্ধিজীবী ও উদ্যোক্তারা উপস্থিত হয়েছিলেন এই অডিটোরিয়ামে। শিক্ষা বিশেষ করে ইংরেজি মাধ্যম স্কুল গড়তে এই কনভেনশন অবশ্যই সকলকে প্রেরণা জোগাবে।
সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এদিকে মিশন কেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠানে ছেলেমেয়েদের পড়ানোর জন্য মুসলিম সমাজে সার্বিক সচেতনতা তৈরি হলেও ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানোর প্রবণতা সেভাবে দেখা যাচ্ছে না। তবে অন্যান্য সম্প্রদায় এ ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে পিছিয়ে পড়ছে সংখ্যালঘু পড়ুয়ারা।এর থেকে উত্তরণের উপায় এবং ইংরেজি মাধ্যম স্কুল গড়ে তোলার বিষয়ে শিক্ষা কনভেনশন করল ইউনাইটেড গার্জেন কাউন্সিল।
রাজ্যের বিশিষ্টজনদের নিয়ে তৈরি এই মঞ্চের তরফে রবিবার পার্ক সার্কাসে অবস্থিত ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের সভাঘরে ছিল সারাদিনব্যাপী এক আলোচনাসভা। সেখানেই পশ্চিমবাংলার মুসলিমদের অবস্থান ও ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষার গুরুত্ব নিয়ে আলোকপাত করেন বিশিষ্টরা। বেশিরভাগ বক্তারাই একমত হন যে, সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা সময়ের দাবি।
এ দিনের আলোচনায় বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ও গবেষক সাবির আহমেদ শিক্ষা– স্বাস্থ্য কর্মসংস্থানে রাজ্যের মুসলিমদের অবস্থান সম্পর্কে পরিসংখ্যান পেশ করেন। সাবির আহমেদ অমর্ত্য সেনের প্রতীচি ফাউন্ডেশনের গবেষণা ও জরিপের সঙ্গে যুক্ত। বিশিষ্ট সমাজসেবী ও প্রাক্তন আমলা নুরুল হক রাজ্য বোর্ড– সিবিএসই এবং আইসিএসই বোর্ডের সিলেবাস, পঠনপাঠনের ধরণ ইত্যাদির পার্থক্য নিয়ে আলোচনা করেন। ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য কী কী করণীয় তা উল্লেখ করেন। তিনি স্বাস্থ্যের উপরও খুবই গুরুত্ব দেন এবং বলেন, এনজিওগুলির উচিত স্বাস্থ্য সম্পর্কে আলোচনা সভার আয়োজন করা। আমানত ফাউন্ডেশনের প্রধান শাহ আলম সাহেব প্রতিশ্রুতি দেন, খুব শীঘ্রই তিনি স্বাস্থ্য নিয়ে একটি সেমিনারের আয়োজন করবেন।
পুবের কলম-এর সম্পাদক ও সাবেক সাংসদ আহমদ হাসান ইমরান সংখ্যালঘু শিক্ষা, আবাসিক স্কুল প্রভৃতি বিষয়ে সার্বিক দিকনির্দেশনায় ইউনাইটেড গার্জিয়ান কাউন্সিলের এরকম অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য উদ্যোক্তাদের অভিনন্দন জানান। তিনি মূল সংগঠন আমানত ফাউন্ডেশনের প্রথম দিনগুলির কথা স্মরণ করেন। তিনি বলেন, পোলিও নির্মূলে একসময় মুসলিম এলাকাগুলিতে অবহেলা করা হত। অথচ সংখ্যালঘুদের উপরই দায় চাপিয়ে দেওয়া হত যে তারা পোলিওর ওষুধ গ্রহণের বিরোধিতা করে যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ইসলামে বলা হয়েছে সব রোগেরই প্রতিষেধক আল্লাহ্ তৈরি করেছেন। আর আমানত ফাউন্ডেশন ও আলেমদের সঙ্গে নিয়ে তিনি ও জনাব শাহ আলম এই ভ্রান্ত ধারণা দূর করতে সক্ষম হন।
ইমরান বলেন, বর্তমানে দেশে অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে ও হচ্ছে। মুসলিম মিশনগুলিকে এখন থেকে তাদের সরকারি স্বীকৃতি ও অন্যান্য বিষয়গুলি সঠিক করে রাখতে হবে। অসমে সব সরকারি মাদ্রাসা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এমনকি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে মুসলিমদের নিজস্ব যাকাত-ফিতরার টাকায় পরিচালিত দু’টি কওমি মাদ্রাসাও।
আহমদ হাসান আরও বলেন, আমাদের নিজেদেরকেই অধিকার আদায় করে নিতে হবে। আর এজন্য সংখ্যালঘু মুসলিম সমাজকে শিক্ষার অগ্রগতির প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। ছেলে-মেয়েদের দ্বীনি শিক্ষার পাশাপাশি যথাযথ আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। ইংরেজি শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব আরোপের কথাও বলেন ইমরান। দ্বীন শিক্ষার জন্য সানডে স্কুল বা সামার ক্যাম্প করার উদ্যোগ গ্রহণের কথা বলেন ইমরান। তিনি বলেন, আমাদের ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, স্বামী বিবেকানন্দের মতো বেগম রোকেয়া, শেরে বাংলা ফজলুর হক, শামসুল হুদা, স্যার আজিজুল হক,এর মত মুসলিম সমাজের শিক্ষার আইকনদেরও স্মরণ করতে হবে। যাদের দেখে বর্তমান মুসলিম সমাজ এগিয়ে যাবে। পুবের কলম পত্রিকা মুসলিম সমাজের সর্বস্তরের সার্বিক অবস্থা তুলে ধরছে বলেও তিনি জানান। তিনি শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও এবং সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে পরস্পরকে সহযোগিতার আহ্বান রাখেন। এবছর বিভিন্ন ইংরেজি মাধ্যম সর্বভারতীয় স্কুল পরীক্ষায় যেভাবে রাজ্যের মুসলিম ছাত্রছাত্রীরা শীর্ষস্থান অধিকার করেছে তাদের ইমরান মোবারকবাদ জানান।
এই অঞ্চলে ইউনিসেফের প্রধান জনাব মহিউদ্দিন সাহেব বলেন, আমি দেশ-বিদেশে ঘুরে দেখেছি প্রশাসন ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকেন আমলারা। তবে এ রাজ্যে বাঙালি আইএসএস বা আপিএস কম। এই জায়গা থেকে চেষ্টা করতে হবে প্রশাসনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যাতে এখানকার বাঙালিরাও বেশি সংখ্যায় স্থান পান।
আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য জনাব আবু তাহের কামরুদ্দিন বলেন, শুধু শিক্ষা নয়, সত্যিকারের অর্থে উন্নতি করতে হলে প্রয়োজন প্রবল ইচ্ছাশক্তি। ইচ্ছাশক্তি থাকলে অনেক বাধা পেরিয়েও সাফল্য অর্জন করা যায়। তিনি এ প্রসঙ্গে ইতিহাস থেকে উদাহরণ তুলে ধরেন।
রেড রোডের ইমামে ঈদাইন ক্বারী ফজলুর রহমান বলেন, বর্তমানে যে পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে তাতে হয়তো মাদ্রাসা শিক্ষা প্রবলভাবে বাধাপ্রাপ্ত হবে। তাই দ্বীনি শিক্ষাকে ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে পরিবারগুলিকেও এগিয়ে আসতে হবে। তিনি আমানত ফাউন্ডেশনের উদ্যোগের প্রশংসা করেন।
এ দিন ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার বিষয়ে বক্তব্য রাখেন আমানত ফাউন্ডেশনের অধিকর্তা শাহ আলম, নাখোদা মসজিদের ইমাম মাওলানা শফিক কাসেমী, প্রিন্সিপাল নজিবর রহমান। এছাড়াও অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত থেকে বক্তব্য রাখেন প্রাক্তন পুলিশ অফিসার মসিউর রহমান, আহলে হাদিসের আলমগীর সরদার, অধ্যাপক আবদুল ওহাব, সমাজকর্মী মুহাম্মদ নুরুদ্দিন, শিক্ষাকর্মী আজিজুর রহমান, প্রফেসর ডা. মুমতাজ সংঘমিতা, উদ্যোক্তা সংগঠনের আইনজীবী মাসুদ করীম ও জালালউদ্দিন আহমেদ প্রমুখ।