সেখ কুতুবউদ্দিন: তোরা মুসলিম, দূরে দাঁড়া, ছুঁবি না! সম্প্রদায়ের একাংশের মধ্যে ‘ছোঁওয়া-ছুঁইয়ি’ রেওয়াজ গ্রামগঞ্জে হামেশায় দেখা যেত। এখন্স সেটা অবশ্য ক্ষীণ।
গ্রামেগঞ্জে সেই কুসংস্কারের বিনষ্ট হচ্ছে। পাশাপাশি বসবাসে নজির সৃষ্টি হচ্ছে অধিকাংশ জায়গায়। শহরের দিকেও সব সম্প্রদায়ের মানুষ একসঙ্গে থাকছেন। তবে কলকাতার কিছু কিছু অঞ্চলে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষদের ঘরভাড়া থেকে ফ্ল্যাট বিক্রিতে রয়েছে মারাত্মক এলার্জি। কলকাতার এই অঞ্চলগুলির মধ্যে টালিগঞ্জ, যাদবপুর, গড়িয়াহাট, শ্যামবাজার, বাগবাজার সহ বেশ কিছু এলাকা।
ঘরভাড়া অথবা ফ্ল্যাটবাড়ি ‘খুঁজতে গেলে তো মুসলিম নাম শোনা মাত্রই এক্কে বারে না। এই অভিযোগের কথা সোশ্যাল মিডিয়া ভুড়িভুড়ি।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক পড়ুয়ার সঙ্গে কথা হচ্ছিল। বিজ্ঞান বিভাগের ওই মুসলিম পড়ুয়ার বক্তব্য, সব ছাত্রছাত্রীর হস্টেলে থেকে পড়াশোনা করানো সম্ভব নয়। তাই অধিকাংশ পড়ুয়াকেই থাকতে হয় কোনও না কোনও ভাড়া বাড়িতে। আর এতেই বিপত্তি।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাজমুল গাজি। বাড়ি গ্রাম এলাকায়। তাই হস্টেলের ‘খোঁজার’ জন্য তাকে দেখতে হয়েছে নাকানিচুকানি।
পড়াশোনার জন্য থাকার বাড়ি অথবা মেস চাই। ক্যাম্পাসের আশপাশে থাকলেই ভালো হয়। তাই যাদবপুরের পোদ্দারনগর, বিজয়গড়, গড়ফা প্রভৃতি এলাকায় ঘর ‘খুঁজতে’ ছুটাছুটি করতে হয় পড়ুয়াদের। কোথাও অমুসলিম পড়ুয়া কাছে, আবার কোথাও পোস্টার থেকে নম্বর সংগ্রহ। সেখান থেকে নম্বর নিয়ে বাড়ি মালিককে ফোন করলে প্রথমে বলেন হবে। আবার কেউ কেউ মুসলিম নাম শুনলেই না করে দেয়।
মেস অথবা ভাড়াবাড়িগুলির মধ্যে যাঁরা কথা বলার জন্য যেতে বলেন। বাড়িওয়ালাদের কাছে গিয়ে আবার অন্য অভিজ্ঞতা। জিজ্ঞেস করলে প্রথমে বলে হবে। কোনও কোনও বাড়ির জন্য অ্যাডভান্স দেওয়ার পর আসার তারি’ বলে দেয়। তার পর গেলে তাদের বলে অ্যাডভান্স টাকা ফেরত নিয়ে যান। ভাড়া দেওয়া যাবে না, মুসলিমদের ভাড়া দিই না। এক ছাত্রীকে এমন ঘটনার পর হতাশা হয়ে ফিরতে হয়। ভাড়া না মেলার ফলে তাদের ক্যাম্পাসের আশপাশে থাকার সুযোগ মেলে না। দূরের কোথাও থাকতে হচ্ছে তাঁদের। এতে ক্লাসের ক্ষেত্রেও অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে পাওয়া এক তথ্য অনুসারে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া-গবেষক মিলে মোট রয়েছেন ১২ হাজার। এর মধ্যে মুসলিম ছাত্রছাত্রী-গবেষক ২০ শতাংশ। ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ বাইরে থেকে এসে পড়াশোনা করেন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলে থেকে পড়াশোনা করতে পারেন ১০ শতাংশ পড়ুয়া।
যাদবপুরের পড়ুয়াদের আক্ষেপ, ‘যেখানেই যাই, প্রাথমিক কথাবার্তায় সকলেই সন্তুষ্ট হন। তার পরে যেই মুসলিম নাম শোনেন, তখনই বলেন, আপাতত বাড়ি ভাড়া দেওয়া সম্ভব নয়। কেউ বা বলেন, ‘পরে খবর দেব।’ সেই ‘পর’ অবশ্য আর আসে না।’
তাঁদের কথায়, কলকাতার একটি বাড়িতে তাঁর নাম শোনার পরে গৃহকর্তা বলেন, ‘আমার স্ত্রী বাড়িতে পুজোআর্চা করেন তো। আপনাকে তাই বাড়ি ভাড়া দিতে পারব না।’ অনেকে আবার স্থান দিলেও, লুকিয়ে নামায, বা কুরআন পড়তে হবে। কারণ বাড়ির মালিকের মা-বাবা পছন্দ করেন না।
রমজান সেখ এবং তাঁর বন্ধু যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি স্কলার। দীর্ঘ ৯ মাস থেকে রমযান এবং তাঁর বন্ধু হাসান গায়েন যাদবপুর এলাকায় তন্নতন্ন করে ‘খুঁজতে’ ফ্ল্যাট পাননি। কারণ একটাই, তাঁরা মুসলিম!
তাঁরা কোনও দালালদের ফোন করলে উনারা নাম জানতে চায়। পরে বলে দুঃখিত। এখানে মুসলিমদের ঘর ভাড়া পাওয়া খুব মুশকিল। একাধিক ব্রোকারকে অনুরোধ করলে অবশেষে রাজিও হন। সব কিছু ঠিকঠাক। যখন ফ্ল্যাটে ঢুকতে যাবেন, তার দু’একদিন আগে ফোন করে বলেন, যে ‘প্রবলেম’ আছে। তাই ফ্ল্যাট ভাড়া দেওয়া হবে না। প্রতিটি ক্ষেত্রে একই ঘটনা ঘটে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁরা জানান, ‘আমাদের অপরাধ, একটাই যে, আমরা ‘মুসলিম’! দীর্ঘ ৯ মাস থেকে ঘর ‘খুঁজছি। এখনও পর্যন্ত একটা ঘর বা ফ্ল্যাটের ব্যবস্থা করা সম্ভব হল না তাঁদের। এই নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁরা সাহায্যের আর্তি জানিয়ে বলেছেন, ‘কেউ সহযোগিতা করলে উপকৃত হব।
মেটিয়াবুরুজ, খিদিরপুর, রাজাবাজার, পার্ক সার্কাসের মতো কিছু এলাকা বাদ দিলে এই শহরের অন্যত্র মুসলিমদের বাড়ি ভাড়া পাওয়া নিয়ে সমস্যা সেই দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে। অতীতে সাহিত্যিক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজকেও এমন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। ক্ষুব্ধ লেখক তখন প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘আমি মুসলমান, না লেখক?’ একই অভিজ্ঞতা হয়েছিল জাতীয় স্তরের এক সাংবাদিকেরও। বাড়ি খুঁজে হন্যে হয়েছিলেন এক জনপ্রিয় গায়কও। তবে এ’ন অধ্যাপক- গবেষক ও ছাত্রছাত্রী মহলের প্রশ্ন, মুসলিমরা যাবেন কোথায়?